রেসিংয়ে ইতিহাস গড়া কাশফিয়া স্টিয়ারিং ধরেন ছোটবেলায়

আন্তর্জাতিক কার রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ইতিহাস গড়লেন কাশফিয়া আরফা। সম্প্রতি ভিয়েতনামের হ্যানয়ে এশিয়ান অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন ২০ বছর বয়সী আরফা।

আন্তর্জাতিক কার রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ইতিহাস গড়লেন কাশফিয়া আরফা। সম্প্রতি ভিয়েতনামের হ্যানয়ে এশিয়ান অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন ২০ বছর বয়সী আরফা। বাংলাদেশের প্রথম নারী রেসিং ড্রাইভার হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি।

ট্র্যাকটিস রেস হিসেবে পরিচিত এশিয়ান অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপে ষষ্ঠ হওয়ার পর ইনস্টাগ্রাম পোস্টে ২০ বছর বয়সী আরফা জানিয়েছেন, এশিয়ান অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপে মিক্সড ডাবল ক্যাটাগরিতে সেকেন্ড রাউন্ডে ষষ্ঠ স্থান পেয়েছেন তিনি। অংশ নিয়েছিলেন নারীদের সলো ইভেন্টেও। সলোতে মালয়েশিয়ান ও ভিয়েতনামি প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে নবম স্থান পান। কাশফিয়া জানান, তিনি তার এ অদম্য যাত্রা অব্যাহত রাখতে চান। আরফা এফআইএ (ফিয়া) এএসএন জাতীয় রেসিং লাইসেন্সের অধিকারী।

ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন আরফা। তিনি ভিকারুননিসার হ্যান্ডবল টিমেও ছিলেন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ হ্যান্ডবল টিমেও খেলেছেন। বর্তমানে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এএবি) সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

এ প্রতিযোগিতায় কাশফিয়া চালিয়েছেন একেবারে নতুন একটি গাড়ি। একটি নতুন ট্র্যাক লে-আউটে তিনি পার করেন তার প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ। সেখানেই আরফা দক্ষতা দেখিয়েছেন। রেস শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরফা দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গর্ব করেন। তিনি লিখেছেন, ‘দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী রেসিং ড্রাইভার এবং ইন্টারন্যাশনাল অটোমোবাইল ফেডারেশন (এফআইএ) এএসএন জাতীয় রেসিং লাইসেন্সের হোল্ডার হতে পেরে গর্বিত। এটা তো মাত্র শুরু। আরো অনেক কিছু আসছে।’

বণিক বার্তাকে কাশফিয়া বলেন, ‘নিজের স্বপ্নের পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে পারাটা ভাগ্যের বিষয়। বাংলাদেশের প্রথম নারী রেসার হিসেবে এমন একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। আমার মতে, এ সাফল্য শুধু আমার জন্য নয়, দেশের জন্যও একটি বড় অর্জন। এ অর্জন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে সামনে আরো বড় লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে। আমার এ যাত্রা আরো নারীদের এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা হবে বলে মনে করি।’

এএবির স্পোর্টিং ডিরেক্টর সৈয়দ আহরারুল হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, আরফা প্রথম বাংলাদেশী রেসার হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। আহরারুল বলেন, ‘কাশফিয়া প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক এফআইএ মোটরস্পোর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।’

আরফা দেশের মেয়েদের মোটর স্পোর্টসকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার অনুপ্রেরণা দেন। তিনি মনে করেন, তার এ অর্জন অন্য অনেককে অনুপ্রেরণা দেবে। বণিক বার্তাকে আরফা বলেছেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ফর্মুলা ওয়ানকে ভালোবাসি এবং রেসিং ওয়ার্ল্ডের অংশ হওয়াটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমি ২০১৮ সালে সহযোগী আলিফ হোসেন খানের সঙ্গে ড্রাইভিং শুরু করি। তিনিই আমাকে প্যাশনটা প্রফেশনে রূপ দিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার সহযোগিতা ছাড়া আমি সামনে এগোতে পারতাম না।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রথম গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা অবশ্যই রোমাঞ্চকর ছিল। খুব ছোটবেলায়ই স্টিয়ারিং ধরেছিলাম। ছোট থেকেই গাড়ির প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। ফাঁকা জায়গা পেলে সেখানে গাড়ি চালাতাম। ছোটবেলা থেকেই গাড়ির প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করতাম। রেসিংয়ের গতি এবং চ্যালেঞ্জের মধ্যে এক ধরনের রোমাঞ্চ কাজ করে। প্রতিটি মুহূর্তের জন্য ফোকাসড থাকতে হয়, এটা আমাকে রেসিংয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।’

কার রেসিংয়ে আসার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেলেন, সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল আমি যেটাই করি না কেন আমার দেশকে যেন বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারি। দেশের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা থেকেই মূলত এ ধরনের প্রতিযোগিতায় আমার অংশ নেয়াটা শুরু হয়।’

এ মাসেই আরেকটি চ্যালেঞ্জ, আরেকটি প্রতিযোগিতায় নামছেন কাশফিয়া। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৭ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া মালয়েশিয়ান ফেস্টিভ্যাল অব স্পিড প্রতিযোগিতার জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ বছরই স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় রয়েছে এফআইএ মোটরস্পোর্ট প্রতিযোগিতা। আমার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো স্পেনে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড কাপে অংশ নেয়া। আমার অধিনায়ক রাসেল রহমান ও অভিক আনোয়ার অবিশ্বাস্য দুই মেন্টর, যাদের সহযোগিতা নিয়ে আমি খেলাটিতে উন্নতির ধারায় থাকতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা, মোটরস্পোর্ট খেলায় আমি বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি করে মেয়েদের অংশগ্রহণে উৎসাহ জোগাতে চাই।’

ছোটবেলায় বাবাকে হারান কাশফিয়া। এরপর তার মা দুই বোনকে আগলে রেখে বড় করেছেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি সবসময়ই এমন কিছু করতে চেয়েছি, যা আমাকে আলাদা পরিচিতি এনে দেবে এবং দেশের জন্য গর্বের কারণ হবে। যদিও রেসিংয়ের প্রতি আমার আগ্রহ পরে তৈরি হয়, ছোটবেলা থেকেই আমি সবসময় চেয়েছিলাম ব্যতিক্রমী কিছু করতে। আমার সেই স্বপ্ন পূরণের পথে আমি অনেকটাই এগিয়ে গেছি। একজন রেসার হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি, যা আমার জীবনের একটি বড় অর্জন। তবে আমি মনে করি স্বপ্ন পূরণের পথটা একটি চলমান প্রক্রিয়া—এখনো অনেক কিছু করার আছে এবং আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করছি।’

জানা গেছে, এর আগে সৈয়েদা শিরহানা হক, মাইশা জেরিন খান ও স্নিগ্ধা রহমান জাতীয় রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তবে এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন কোনো বাংলাদেশী নারী। আরফার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরো অনেক কিশোরী এফআইএ ন্যাশনাল মোটরস্পোর্ট প্রতিযোগিতায় নাম লেখাচ্ছেন বলে জানান সৈয়দ আহরারুল হোসেন।

বাংলাদেশে কার রেসিং কতটা কঠিন চ্যালেঞ্জিং? এমন প্রশ্নের জবাবে কাশফিয়া বলেন, ‘আমার মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার রেসিং কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। এজন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মানের রেসিং ট্র্যাক, গাড়ি কিংবা প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণের যথেষ্ট অভাব আছে। তবে বর্তমানে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ দেশের রেসারদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা দিচ্ছে। নারীদের রেসিংয়ে উদ্বুদ্ধ করা ও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্ম ও বিভিন্ন সংগঠন ধীরে ধীরে রেসিংয়ে আগ্রহী হচ্ছে, এটা আশাব্যঞ্জক। আমি মনে করি, সঠিক সমর্থন ও পরিকল্পনা থাকলে বাংলাদেশেও কার রেসিংয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে।’

এ খেলাটি কতটা ব্যয়বহুল? মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ কি কার রেসিংয়ে নাম লেখাতে পারবে? উত্তরে কার রেসিংয়ের আগামীর এ তারকা বলেন, ‘হ্যাঁ, অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু যদি কারো প্রতিভা থাকে তাহলো অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তারা গাইড করবে।’

আরও