পেঁয়াজ আমদানির বিকল্প উৎস কী?

নিত্যদিন যে কৃষিপণ্যটি বাজারে দাম বৃদ্ধিতে আলোচনার কেন্দ্রে থাকে তার মধ্যে অন্যতম পেঁয়াজ। সাপ্লাই চেইনে কোথাও বিঘ্ন সৃষ্টি হলে দাম বৃদ্ধির সব সমীকরণই যেন হার মানে পেঁয়াজের কাছে। পেঁয়াজ কিনতে টিসিবির ট্রাকের সামনে লম্বা লাইন। গত বছরের এ চিত্র সবারই চোখের সামনে ভাসছে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে মধ্যবিত্তের দৌড়ানোর চিত্রও নাড়া দিয়েছিল মানুষের মনে। পেঁয়াজ যেন ক্রয়ক্ষমতার

নিত্যদিন যে কৃষিপণ্যটি বাজারে দাম বৃদ্ধিতে আলোচনার কেন্দ্রে থাকে তার মধ্যে অন্যতম পেঁয়াজ। সাপ্লাই চেইনে কোথাও বিঘ্ন সৃষ্টি হলে দাম বৃদ্ধির সব সমীকরণই যেন হার মানে পেঁয়াজের কাছে। পেঁয়াজ কিনতে টিসিবির ট্রাকের সামনে লম্বা লাইন। গত বছরের এ চিত্র সবারই চোখের সামনে ভাসছে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে মধ্যবিত্তের দৌড়ানোর চিত্রও নাড়া দিয়েছিল মানুষের মনে। পেঁয়াজ যেন ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। কেউ কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবেও পেঁয়াজ নিয়ে হাজির হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, পেঁয়াজ দিয়ে বানানো গহনা, নানা গান, কবিতা, মিম। একটি নিত্যপণ্য রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছিল যে বিয়ে বাড়ি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। এর মূলে রয়েছে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম। 

দেশের বাজারে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। এরমধ্যে পাঁচ-সাত লাখ টন আমদানি করতে হয়। বাকিটা দেশীয় পেঁয়াজ দিয়ে মেটানো হয়। আমদানীকৃত পেঁয়াজের বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। ভারত সরকার গত বছর ৯ ডিসেম্বর পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। এর পরই বাংলাদেশে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। যে পেঁয়াজ আগের দিন প্রতি কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হতো, পরদিন তা ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এমন প্রেক্ষাপটে ভোক্তা ব্যবসায়ীদের দাবি, পেঁয়াজ আমদানির বিকল্প উৎসের সন্ধান কেন নয়। কী কী হতে পারে এর বিকল্প। 

সর্বশেষ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশীয় ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি পাইকারিতে ১২০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান, চীন, মিসর ও থাইল্যান্ড থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করেন। বিকল্প দেশগুলো থেকে সমুদ্রপথে আমদানি শুরু হওয়ায় বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিনে পাইকারি বাজারে দেশীয় ও ভারতীয় পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম কমে ১০৩-১০৫ টাকায় নেমে এসেছে। 

বর্তমানে ভারত থেকে এককভাবে আমদানির বিকল্প হিসেবে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে পাকিস্তানসহ চারটি দেশ থেকে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে অস্থির পেঁয়াজের বাজারে এখন কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা তখনই স্বস্তিতে থাকবেন যখন পেঁয়াজ আমদানির বিকল্প বাজার তৈরি হবে।

জানা গেছে, সারা দেশের আমদানিকারকরা বিভিন্ন দেশ থেকে স্থল ও সমুদ্রপথে পেঁয়াজ আনার চেষ্টা করছেন। গত দুই মাসে তারা ২ লাখ ৮০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র নিয়েছেন উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে। সাধারণত অনুমতি নেয়ার চার মাসের মধ্যে পণ্য আমদানি করতে হয়। এ সময় আরো দুই মাস বাড়ানো যায়।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর শাখার তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জুলাইয়ে ৬৭০ টন পেঁয়াজ আমদানি হলেও আগস্টে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫০৯ টনে। এ দুই মাসে মোট ৫ হাজার ১৭৯ টন আমদানি হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩ হাজার ৪৯৮ টন এসেছে পাকিস্তান থেকে। এছাড়া মিসর থেকে ১ হাজার ১১ টন, চীন থেকে ৬৬৭ ও থাইল্যান্ড থেকে পাঁচ টন আমদানি হয়েছে। খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে প্রতি কেজি দেশী এবং ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১০৪-১০৫ টাকায়, মিসরের পেঁয়াজ ৮০, পাকিস্তানি পেঁয়াজ ৮৫ ও চীনের পেঁয়াজ ৭০ টাকায় বিক্রি হয়।

পেঁয়াজ আমদানির অন্যতম উৎস ভারত সরকারের সর্বনিম্ন রফতানি মূল্য প্রতি টন ৫৫০ ডলার নির্ধারণ করে ৪০ শতাংশ রফতানি শুল্কারোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজে ৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ও ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) রয়েছে যা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়ে গত ২৯ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

এদিকে আমদানি ও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বাড়ায় দুদিনের ব্যবধানে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কমেছে কেজিতে ১০-১৫ টাকা। দুদিন আগে বন্দরে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১০০-১০৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা কমে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি দাম বাড়ায় আবারো পেঁয়াজের আমদানি বাড়িয়েছেন আমদানিকারকরা। সমুদ্রপথে মিসর, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করেছেন আমদানিকারকরা। যার কারণে দেশের বাজারে আমদানীকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা কমায় দাম কমছে। তবে ভারত সরকার শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলে পেঁয়াজের দাম আরো কমে আসবে।

এদিকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্দর দিয়ে পেঁয়াজের আমদানি আগের তুলনায় বেড়েছে। বন্দর দিয়ে আগে তিন থেকে পাঁচ ট্রাক করে পেঁয়াজ আমদানি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে গতকাল মঙ্গলবার ১৫ ট্রাকে ৪৩৩ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। সোমবার বন্দর দিয়ে তিনটি ট্রাকে ৮৭ টন, রোববার আটটি ট্রাকে ২৩৪ টন, শনিবার সাতটি ট্রাকে ২০৩ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল।

হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক মোবারক হোসেন বলেন, দেশের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত রেখেছেন বন্দরের আমদানিকারকরা। তবে সমস্যা হচ্ছে, পেঁয়াজ রফতানিতে ভারত ৪০ ভাগ শুল্ক আরোপ রাখায় বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে করে আমাদের পড়তা পড়ছে ৯০ টাকার ওপরে। এর ওপর বন্যার কারণে ভারতে পেঁয়াজের দাম ৪-৫ টাকা করে বেড়েছে। যার কারণে বাড়তি দামে আমদানির ফলে দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। তবে দেশে পেঁয়াজের দাম কম থাকায় মাঝে পেঁয়াজ আমদানি করে লোকসান গুনতে হওয়ায় পেঁয়াজের আমদানি কমিয়েছিলেন আমদানিকারকরা। এতে করে চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ কমায় দাম কিছুটা বাড়তি হচ্ছিল। 

শ্যামবাজারের আমদানিকারক পেঁয়াজ সমিতির সেক্রেটারি হাজি মো. মাজেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আনতে দুই মাস সময় লাগে। চীন, পাকিস্তান থেকে এক মাস। নদীপথে আনতে হয় তাই পরিবহন খরচও বেশি। কিন্তু ভারত থেকে সাতদিনে পেঁয়াজ আনা যায়। এখন ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি পাইকারি ৯৫ টাকা করে। এছাড়া মিসর ও পাকিস্তানের পেঁয়াজ ৮০-৮৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।’ 

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারের মেসার্স ইরা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের পেঁয়াজের মান ভালো হলেও সরবরাহ তুলনামূলক কম থাকায় বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু একাধিক দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে বাজার স্থিতিশীলতার দিকে ফিরছে। বর্তমানে মিসর, পাকিস্তান ও চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করছেন। একাধিক দেশ থেকে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ছে। আগামী রবি মৌসুমের আগে বাজার সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে চট্টগ্রাম ও হিলি প্রতিনিধি]

আরও