বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অভ্যুদয় হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালি বিংশ শতাব্দীর সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে। সেসব আন্দোলনের প্রতিটি ধাপেই অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তির দাবিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার কার্যক্রম শুরু হয়। ৭১-এ মার্চে অসহযোগ আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিও শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও আধা সামরিক প্রশিক্ষণ। তাই সংগত কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আন্দোলনের উৎসভূমি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে। সে সূত্র থেকেই একাত্তরের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতেই ১৯৬৯ সালের শুরুতে গণআন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। পরে এ গণআন্দোলনই গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সমগ্র দেশে ‘আমার দেশ, তোমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ এবং ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ এ ধরনের স্লোগানে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার চরম অভিব্যক্তি ঘটে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুরু হয় দেশব্যাপী।
৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা ‘বাঙালি এথনিক ক্লিনজিং’ শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এ অপারেশন শুরু করা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাত ১২টা ৫ মিনিটে। ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী। ঢাকা শহরের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবরার। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক ও জগন্নাথ হলে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। কারণ সে সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দুটি হল ছিল সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তবে ৭১-এর ২৫ মার্চ এবং এর পরবর্তী সময়জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ হলেই চলে অমানবিক অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড। দীর্ঘ সময় এ পরিস্থিতির ফলে বিশ্ববিদ্যাল্যের কয়েকজন শিক্ষক আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এবং অনেকেই মুজিবনগর গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
রোকেয়া হলও সেদিন রেহাই পায়নি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী রোকেয়া হলের গেট ভেঙে সেখানে প্রবেশ করে। সেখানে অবস্থান করা ছাত্রীর সংখ্যা ছিল খুব কম। জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলের গুলিবর্ষেণে ছাত্রীরা আবাসিক শিক্ষিকা সাহেরা বেগমের বাসায় আশ্রয় নেন। তবে আর্চার কে ব্লাডের বই ‘দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ থেকে জানা যায় যে সে রাতে রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগান দিয়ে অবিরাম তাদের ওপর গুলি করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রোকেয়া হলে কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে ঢাকার সে সময়ের মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি প্রতিবেদন পাঠান। সেখানে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়। বর্ণনায় দাবি করা হয়, রোকেয়া হলের রুমগুলোতে ছিল রক্তের দাগ। কারো পালানোর জন্য কোনো সুযোগ ছিল না। এদিকে আর্চার কে ব্লাড দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের একটি কক্ষে ছয়টি মেয়ের লাশ পা-বাঁধা ও নগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাদেরকে ধর্ষণের পরে গুলি করে তাদের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এছাড়া রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় হলের কর্মচারী আহমেদ আলী, আবদুল খালেক, নমি, মো. সোলায়মান খান, মো. নুরুল ইসলাম, মো. হাফিজুদ্দিন ও মো. চুন্নু মিয়াকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি মুখগুলোর মধ্যে প্রথমে নাম আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী। তার নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্ববাসীকে জাগ্রত করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মানবাধিকার কমিশনে যোগদানের জন্য তিনি জেনেভায় গিয়েছিলেন। পরে ২৫ মার্চ দেশে গণহত্যার খবর পেয়ে তিনি লন্ডনেই থেকে যান এবং বাংলাদেশের পক্ষে সেখানকার জনমত গঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে অবদান রাখেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ ও অস্ত্র ক্রয়ের ফান্ড গঠনেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের পক্ষে বিশ্বের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে সমর্থন অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। নানা প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। এ সংবাদে স্বাধীন বাংলাদেশের লবি তৎপর হয়ে ওঠে। ড. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এবং পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যার সংবাদে বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। শিক্ষকদের চেষ্টার ফলেই বিশ্ব জানতে পেরেছিল পাকিস্তানের বর্বরতার কথা এবং বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানের প্রতি নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। আবারো নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের ওপর হত্যাযজ্ঞ হওয়ার আশঙ্কায় বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। ফলে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি অবিলম্বে টেলিফোনের মাধ্যমে পাকিস্তানের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং গ্রেফতারকৃত শিক্ষকদের নিরাপত্তা দাবি করেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র এবং প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক সবাই কোনো না কোনোভাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এবং সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে ছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও বেশ কয়েকজন অধ্যাপক। মুজিবনগর সরকারের পাশাপাশি প্রশাসন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীসহ সবার যে ব্যাপক অবদান, এককভাবে বাংলাদেশের অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এর সমকক্ষ ছিল না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের একটি বড় অংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তাই বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরে বিজয়ের লাল সূর্য ওঠা পর্যন্ত সঙ্গে ছিল।
ফারিহা আজমিন: লেখক