বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্পায়নে এক কিলোমিটার প্রস্থের কর্ণফুলী নদী অন্তরায় ছিল। নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল পতেঙ্গা ও আনোয়ারাকে সংযুক্ত করেছে। টানেলের দুটি টিউব ও চার লেনের সড়ক দিয়ে ৭-৮ মিনিটে পতেঙ্গা থেকে যাওয়া যাবে আনোয়ারায়। মূলত চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। পাশাপাশি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার ও সময় প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা কমে আসবে। টানেলের মাধ্যমে ভূ-ভাগের যে আধুনিক সংযুক্তি, সেটি যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসেবে দেখা হলেও দেশের শিল্প-অর্থনীতিতে রাখবে ব্যাপক ভূমিকা। আশা করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের জিডিপিতে ভূমিকা রাখবে ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
রাজধানী থেকে কক্সবাজারগামী গাড়িগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট দিয়ে বন্দর টোল রোডের সঙ্গে নির্মিত আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা হয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করলে চট্টগ্রামের দিকে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এতে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করেই সময় বাঁচাতে পারবেন চালকরা। টানেল দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি (সিইউএফএল) ঘাট-চাতরি, চৌমুহনী-বাঁশখালী-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হলে সৈকত নগরীর দূরত্ব কমবে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের মতো। উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। প্রতি টানেলে রয়েছে দুই লেনের প্রশস্ত রাস্তা। দুই টিউব তিনটি সংযোগপথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে। বিপদকালে অন্য টিউবে যাওয়ার জন্য ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহার করা হবে।
টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপারে রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ একর জমির ওপর কোরিয়ান ইপিজেড। দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম টানেল নির্মাণের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আনোয়ারার একটি ইকোনমিক জোন স্থাপন করছে সরকার। এছাড়া বেজার মাধ্যমে কর্ণফুলী দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারা উপজেলায় প্রায় ৮০০ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যভুক্ত অনেকে বিনিয়োগ করছে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায়। এছাড়া টানেলের দক্ষিণ পাড় থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত চার লেনের সড়কের পাশে কারখানা স্থাপনের জন্য অনেকেই ক্রয় করেছেন জমিও। শিল্পায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে টানেলকে ঘিরে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে টানেলের মধ্য দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচলের সংখ্যা অনেকাংশে বাড়বে।
তবে ওয়ান সিটি টু টাউন নির্মাণের এখনো বেশকিছু সংকট রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম মহানগরী অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম শহরকে সম্প্রসারণ করার জন্য আনোয়ারাকে নতুন শহর নির্মাণ করে চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সংযুক্ত করার মহাপরিকল্পনা আছে। যদিও আনোয়ারায় এখনো নতুন শহর তৈরির যে পরিকল্পনা সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আনোয়ারায় যে নগরায়ণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার মাস্টার প্ল্যান এখনো তৈরি হয়নি। এখানে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজাতে হবে যে কেউ চাইলে এ এলাকায় যেখানে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। সেটা আবাসন হোক কিংবা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। সেখানে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে, আবাসন ও শিল্পায়ন হবে সম্পূর্ণ পরিকল্পিভাবে। আনোয়ারা হবে নতুন চট্টগ্রাম নগরীর বড় একটি অংশ। শহরটিকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হলে একটি বড় ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আনোয়ারার আবাসিক জোন, শিল্প জোন, স্পোর্টস জোন কিংবা পর্যটন জোনের মতো আলাদা জোন তৈরি করতে হবে। পরিকল্পনায় নিশ্চিত করতে হবে নাগরিক সব সুবিধা। তাহলেই একটি নতুন পরিকল্পিত নগরী গড়ে উঠবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সফল হবে ওয়ান সিটি, টু টাউন মডেল।
বঙ্গবন্ধু টানেলের দুই পাশের সড়ক ব্যবস্থাপনার কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। এরই মধ্যে দোহাজারী পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথের সঙ্গে আরো ১০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে রেলপথে যুক্ত করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে মনে করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারা প্রান্তে টানেলের মুখ একদিকে পটিয়া হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ন্যাশনাল হাইওয়ে-১-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। যার সম্প্রসারণের কাজ বাস্তবায়নাধীন। একই প্রান্তে বাঁশখালী-পেকুয়ার (আর ১৭০) সঙ্গে সংযুক্ত সড়কটি সরকারের নতুন পরিকল্পনা মোতাবেক বাঁশখালী-পেকুয়া-চকরিয়া-ঈদমণি-খুরুশকুল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। যার ফলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৩৫-৪০ কিলোমিটার কমে যাবে। এছাড়া নতুন পরিকল্পিত রুটের সঙ্গে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা যেতে পারে, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার কমিয়ে আনতে পারে।
টানেলকে ঘিরে নেয়া বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, সরকারি সব সংস্থার সমন্বয় আর ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী দশকে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।
ব্রুজ খলিফাকে বলা হয় আরব আমিরাতের দুবাই শহরের সব থেকে সুন্দর আইকনিক অবকাঠামো ও ইমারত। এর নান্দনিকতা এবং নির্মাণশৈলী এতটাই মানুষের মনে গেঁথে গেছে যে, বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই টাওয়ারটি দেখতে ছুটে যান। ব্রুজ খলিফার মতোই চীনের মহাপ্রাচীর, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি কিংবা সাবেক টুইন টাওয়ার, ভারতের তাজমহল, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারের মতো নান্দনিক অবকাঠামো দেশের পরিচিতিকে তুলো নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের আইকনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হিসেবে এখন বিবেচিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। তবে দেশের ইতিহাসে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে প্রথম টানেল নির্মাণ করা হয়েছে চট্টগ্রামে। নান্দনিক এ ‘দ্য বিউটি অব টানেল’-এর কারণে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম এখন নতুনভাবে পরিচিত হয়ে উঠবে।