আশির দশকের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বাগেরহাটে নারকেল তেলের ব্যবসা ছিল রমরমা। এখানকার নারকেল তেলের কদর ছিল দেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষতিকর পোকা ও ইঁদুরের আক্রমণে নারকেলের ফলন হারাতে বসে। দেশজুড়ে তেলেরও জৌলুস আগের মতো নেই। তবে এবার তেল নয়, নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি শোপিস যাচ্ছে ইউরোপে।
বিসিকের নারকেলের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজ আহমেদ বিকল্প ব্যবসার চিন্তা করেন। নারকেলের উচ্ছিষ্ট ছোবড়া পড়ে থাকে যত্রতত্র, আসে না কোনো কাজে। কীভাবে কাজে লাগানো যায় এ ছোবড়া। তখন নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন তিনি।
ফেলনা ছোবড়া দিয়ে নতুন পণ্য তৈরিতে মনোযোগী হন মোস্তাফিজ। ২০০২ সালে শুরু হয় তার নতুন উদ্যোগ ছোবড়ার আঁশ দিয়ে যন্ত্রে তৈরি তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ, কয়ার ফেল্ট তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ। ম্যাট্রেস ছাড়াও কয়ার ফেল্ট ব্যবহার হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এয়ার ফিল্টার ও ইনসুলেশনের কাজে।
বাগেরহাট বিসিকে অবস্থিত তার সেই কারখানা ২০০৫ সালে উৎপাদনে যায়। প্রথমবারের মতো দেশে উৎপাদন শুরু হয় নতুন ধরনের শোপিস এ পণ্য। বাজারও পেয়ে যান মোস্তাফিজ আহমেদ। সে সময় সোয়ান, আখতার, পারটেক্স, টাইগারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিতে শুরু করে কয়ার ফেল্ট। রফতানি শুরু হয় বিদেশেও। ছোবড়া থেকে তৈরি পণ্যের তালিকায় ধীরে ধীরে যুক্ত হয় কোক পিট, ডিসপোজেবল স্লিপারের মতো পরিবেশবান্ধব নতুন নতুন সব পণ্য। মোস্তাফিজ আহমেদ তার ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদকে যুক্ত করেন ব্যবসায়।
তাদের উৎপাদিত পণ্যের বড় অংশই রফতানি হয় জার্মানি, ইংল্যান্ড, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরে দেশের রফতানি পণ্য তালিকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য কাঠের তৈরি সাইকেল, পোষা প্রাণীর খেলনা, সফট টয়, পাখির বাসাসহ বেশ কয়েক ধরনের পণ্য।
বাগেরহাটের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরীতে ন্যাচারাল ফাইবার নামের দুই সহোদরের এ কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে শতাধিক নারী-পুরুষের।
মোস্তাফিজ আহমেদ জানান, ছোবড়া দিয়ে কিছু করার চিন্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। ভারতের বিভিন্ন এলাকার (হরিয়ানা, দিল্লি, কেরালা, তামিলনাড়ু ও ওড়িশা) কারখানায় ছোবড়া দিয়ে কয়ার ফেল্ট তৈরির কৌশল দেখলেন। যন্ত্রপাতি কিনতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেলেন, দাম আকাশছোঁয়া। কিন্তু হাল ছাড়ার জন্য সেখানে যাননি মোস্তাফিজ। পশ্চিমবঙ্গের এক কারখানার সঙ্গে চুক্তি করে কয়ার ফেল্ট তৈরি করে নিয়ে আসতে থাকলেন। কিন্তু এতে খুব বেশি লাভ না হওয়ায় ২০০২ সালে দেশে ফিরে নিজের চেষ্টায় স্থানীয় উপকরণ ও মিস্ত্রি দিয়ে কয়ার ফেল্টের যন্ত্রপাতি তৈরি করেন তিনি। কিন্তু ততদিনে পার হয়ে গেছে তিনটি বছর। তবে এর আগেই কয়েকটি ম্যাট্রেসের কারখানার ক্রয়াদেশ পেয়ে যান তিনি। কারখানার পরিধিও বাড়াতে থাকেন। আর পিছু তাকাতে হয়নি, পরে নিয়মিতই পেতে থাকেন কার্যাদেশ।
ম্যাট্রেস তৈরি সম্পর্কে জানালেন মোস্তাফিজ। ছোবড়ার আঁশের সঙ্গে তরল রাবার মিশিয়ে প্রথমে পাতলা শিট তৈরি করা হয়। পরে ম্যাট্রেস কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী কয়েকটি শিটকে তাপ ও চাপ দিয়ে এক ইঞ্চি থেকে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি পুরুত্বের কয়ার ফেল্ট প্রস্তুত করা হয়। প্রথম পণ্য যায় জার্মানিতে। তবে উদ্যমী ভাইদের চিন্তা এখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। নতুন নতুন পরিকল্পনা আর আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি করে অংশগ্রহণের উদ্যোগ নেন।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএসএআইডির এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন (এভিসি) প্রজেক্টের আওতায় জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেয়ারে অংশ নেন মোস্তাফিজ। সেখানে তিনি যান কয়ার ফেল্টের ক্রেতা খুঁজতে। সেখানেই প্রথম বিশ্ববাজারে কয়ার পিটের চাহিদার বিষয়ে জানতে পারেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে নারকেলের ছোবড়ার আঁশ সরবরাহ দিতে আশপাশে ছোট ছোট বেশকিছু কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু পণ্যটির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় ২০১৭ সালে তারা নিজেরাই বাগেরহাটের সদর উপজেলার কররী গ্রামে ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন।
তখন ইউএসএআইডির সহযোগিতায় ভারত থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে ২০১৮ সাল থেকে তারা পিট ব্লক উৎপাদন এবং বাংলাদেশ থেকে প্রথম এই পিট ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি শুরু করেন।
তবে বছর দুয়েক পরেই বিশ্বজুড়ে আঘাত হানে মহামারী করোনা। ধীরে ধীরে রফতানি কমতে থাকে কয়ার ফেল্টের। ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তাদের কারখানা। করোনায় কিছু ক্রেতা ক্রয়াদেশ বাতিল করে দিলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তারা।
মোস্তাফিজের ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ বলেন, ‘করোনায় প্রায় দুই বছর ধরে আমাদের দুটি কারখানাই বন্ধ থাকে। আমরা চেষ্টা করতে থাকি কীভাবে নতুন পণ্য দিয়ে আবারো বাজারে আসা যায়। এজন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমরা আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দিই। সেখান থেকে একদিন আমাদের কাছে গ্রিসের এক ক্রেতা, কোক-মার্ট আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কোক-মার্ট অনেক বড় ও সুপরিচিত কোম্পানি, আমরা আগে থেকেই তাদের চিনতাম। প্রতিষ্ঠানটি আমাদের কাছে নতুন ধরনের একটি পণ্য, ডিসপোজেবল হোটেল স্লিপারের চাহিদা দেয়।’
কারখানাটির এক পাশে কয়ার ফেল্ট তৈরির ইউনিটে চলে স্লিপার তৈরির প্রথম ধাপ। ছোবড়ার আঁশ দিয়ে সেখানে তৈরি শিট থেকে নির্দিষ্ট মাপের ডাইচের সাহায্যে প্রথমে জুতার সুকতলা মতো করে একটি অংশ কেটে নেয়া হয়। এরপর তা নিয়ে আসা হয় কারখানার অন্য অংশে। সেখানে টেইলারিং মেশিনে নারীদের হাতেই ডিসপোজেবল স্লিপারটি তৈরি হয়। পণ্যগুলো তৈরির পর তার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে প্রতি জোড়া এক সঙ্গে করে কাগজের কার্টনে রাখা হচ্ছে রফতানির জন্য।
মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘ক্রয়াদেশ দিয়ে কোক-মার্ট আমাদের কিছু টাকাও অগ্রিম দেয়। তা দিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে পণ্যের উৎপাদন শুরু করি। ছোবড়ার আঁশ দিয়ে তৈরি কয়ার ফেল্ট বা শিট দিয়ে মূলত এ স্লিপার তৈরি হয়। পণ্য তৈরি হলে প্যাকিংয়ের আগে কথা ছিল তারা আমাদের কারখানা ভিজিট করবে। তারা এখানে এসে আমাদের উৎপাদিত পণ্য দেখে বেশ খুশি হয়েছে।’
মোস্তাফিজ আরো বলেন, ‘কয়ার ইয়োগা ম্যাট, ম্যাট্রেসের জন্য কয়ার শিট, বাচ্চাদের ম্যাট্রেস, স্যান বেডের মতো ছোবড়ার তৈরি পণ্যের পাশাপাশি কাঠের তৈরি বাচ্চাদের ব্যালান্সড সাইকেল, পোষা প্রাণী যেমন কুকুর-বিড়ালের বিছানা, ব্রাশ, খেলনা, ছাতা, বোতলসহ ৫ কোটি টাকার পণ্যের অর্ডার করেছে কোক-মার্ট। এছাড়া তাদের চাহিদা অনুয়ায়ী আমরা একটি কাঠের সাইকেল তৈরি করি। পছন্দ হওয়ায় ২০ হাজার সাইকেল অর্ডার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কাঠের একটি থ্রি হুইলারেরও চাহিদা দিয়েছেন এক ব্যক্তি। থ্রি হুইলারটি বাইসাইকেলের মতো চলবে, আবার ব্যাটারিতেও চলবে। কভারটা হবে যুদ্ধবিমানের ককপিট শেডের মতো।’ বর্তমানে ৮০ জনের মতো কাজ করলেও নতুন সব পণ্য উৎপাদন শুরু হলে নতুন আরো ২০০ জনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি।
কারখানার শ্রমিক লিমা বেগম বলেন, ‘১২ বছর ধরে আমি এখানে কাজ করি। সাত সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ আমার ও আমার বোনের আয়ে চলে। সকাল থেকে ম্যাট্রেস তৈরি, বাঁধাই, জুতা প্যাকেজিংসহ সব ধরনের কাজই আমি করি।’
অন্য এক শ্রমিক পান্না বেগম চার মাস আগেও রাস্তায় কাজ করতেন। তবে সব দিন কাজ পেতেন না। ফলে কাজবিহীন দিনগুলো তার অর্ধাহার-অনাহারেই কাটত।
চার মাস আগে কারখানার কাজে যোগ দেয়া পান্না বলেন, ‘রাস্তার কাজ যখন করতাম খুব কষ্টে দিন কাটত। তবে এখন অনেক ভালো আছি। স্বামী অসুস্থ, কাজ করতে পারে না। আমার আয়েই চলে পাঁচ সদস্যের পরিবার।’
কাজ কীভাবে পান
কাজ পাওয়ার বিষয়ে মোজাহিদ বলেন, ‘অনলাইনে আমরা বিদেশী ক্রেতা খুঁজে তাদের প্রস্তাব পাঠাই। অনেক সময় তারাও আমাদের চাহিদা দেয়। সেই অনুযায়ী প্রস্তাব তৈরি করে জমা দেয়া হয়। ক্রেতাদের পছন্দ ও দরদামে পোষালে আমরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য প্রস্তুত করে সরবরাহ করি।’
সংকট
তবে এ ধরনের পণ্য রফতানিতে আমাদের সরকারি নীতিতে কিছু সংকট আছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজ বলেন, ‘সবচেয় বড় সমস্যা হচ্ছে নারকেলের ছোবড়া বা কাঠের কোনো পণ্য রফতানি করতে হলে ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট লাগে। ওই দপ্তরের অসহযোগিতাসহ পরিবেশ অধিদপ্তর এবং দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজেও বেশ বেগ পেতে হয়।’
সম্ভাবনা
ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। এ পণ্যের বৈশ্বিক বাজার পুরোটা প্রায় চীনের দখলে। ৩ মার্চ ডিসপোজেবল স্লিপার রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার এ ধরনের পণ্যের রফতানি শুরু হলো। আমরা এ বাজারে ঢুকলাম এবং আশা করছি, আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা একটা ভালো অবস্থানে যাব। পাশাপাশি বাংলাদেশে এমন কারখানা আরো তৈরি হবে। তাহলে আরো বিদেশী ক্রেতা আসবে। যদি সরকারের কিছু সহযোগিতা থাকে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি এ বাজারগুলো ধরতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তরুণদের জন্য পরামর্শ
মোস্তাফিজ বলেন, ‘আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা, পড়ালেখা শিখেই সবাই চাকরি খোঁজে। অথবা কেউ কিছু একটা করল সবাই সেইটার পেছনে দৌড়ায়। নতুন কিছু করতে চায় না। তাই আমার পরামর্শ শিশুদের পরিবার ও বিদ্যালয় থেকেই উদ্ভাবনী চিন্তায় উৎসাহিত করতে হবে। চাকরিই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, তা বোঝাতে হবে। তাহলে তরুণরা বেকার বসে না থেকে নিজে থেকেই কিছু করবে।’ পাশাপাশি যুবকদের ভয় ঝেড়ে আপন শক্তিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও
করোনায় কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও এ সময়ে সফলতার গল্প লিখেছেন মোজাহিদ আহমেদের সহধর্মিণী রোজি আহমেদ। করোনার সময়ে সবকিছু যখন বন্ধ, তখন শহরের বাসাবাড়ি এলাকায় নিজেদের বাড়িতে তিনি গড়ে তোলেন ছোবড়ার আঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ। প্রথমে ৮-১০ জন নারী শ্রমিক কাজ করলেও এখন সেখানে কাজ করেন প্রায় ৪০ জন নারী শ্রমিক। এ নারীরা নিজেদের ঘরের সব কাজ শেষে অবসর সময়ে কাজ করেন এখানে। ভালো মজুরি পেয়ে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে সংসারেও খরচ দিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে রোজি আহমেদ জানালেন, ছোবড়া দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। করোনার সময় যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, তখন বাড়িতে থেকেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিই। যেহেতু আমাদের ছোবড়া বা আঁশ ছিল, তাই এটি দিয়েই পাখির বাসা বানানো শুরু করি। পর্যায়ক্রমে এখন আমরা পনেরো ধরনের পাখির বাসা, মালচিং ম্যাট, কোকো পোল, বাসকেট, ল্যাম্প শেডসহ প্রায় ২০ ধরনের পণ্য উৎপাদন করে থাকি।