ইউরোপের রাস্তায় চলছে বাংলাদেশের বাইসাইকেল

যাত্রাটা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। একজন দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান মানুষ হিসেবে সাইকেলে সোনালি ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন আবদুল খালেক ভুঁইয়া। মাত্র সাত হাজার বর্গফুটের একটি কারখানা দিয়ে শুরু। স্বপ্নিল সে যাত্রায় সারথি ছিলেন মাত্র ১২ জন কর্মী। বিপুল উদ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে সাইকেলের স্পোক, মডগার্ড ও ফ্রেম। এ হলো মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার গল্প। তারপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি।

যাত্রাটা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। একজন দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান মানুষ হিসেবে সাইকেলে সোনালি ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন আবদুল খালেক ভুঁইয়া। মাত্র সাত হাজার বর্গফুটের একটি কারখানা দিয়ে শুরু। স্বপ্নিল সে যাত্রায় সারথি ছিলেন মাত্র ১২ জন কর্মী। বিপুল উদ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে সাইকেলের স্পোক, মডগার্ড ও ফ্রেম। এ হলো মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার গল্প। তারপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি। সাফল্যময় অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষ সাইকেল রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ।

সাইকেল রফতানিতে বাংলাদেশ ক্রমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোয় বাংলাদেশী সাইকেলের বিশেষ সমাদর আছে। ইউরোস্ট্যাটের তথ্যানুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সাইকেল রফতানিকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। আর বিশ্বে সাইকেল রফতানিতে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে আছে। সাইকেল রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছিল ২০০৭ সালে। সে বছর ৩ লাখ ৫৫ হাজার সাইকেল রফতানি হয়েছিল। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৬ লাখে উন্নীত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি হওয়া সাইকেলের সংখ্যা ১০ লাখে গিয়ে পৌঁছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাইকেল রফতানি করে বাংলাদেশ ৮ কোটি ২৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার আয় করেছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় হয় ১৩ কোটি ৮ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে সাইকেল রফতানি করে বাংলাদেশ ১৬ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার ডলার আয় করেছিল। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি আয় ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ কমে ১৪ কোটি ২ লাখ ৪০ হাজারে নেমে আসে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রফতানি আয় কমেছে বলে জানিয়েছেন রফতানিকারকরা। রফতানি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হলে মেঘনা গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার লুৎফুল বারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে বাইসাইকেলকে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমাদের রফতানি বাজার মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যকেন্দ্রিক। বৈশ্বিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে এসব বাজার বহুলাংশে সংকুচিত হয়েছে। এসব বাজারে কভিড-পরবর্তী যেসব মালপত্র গুদামজাত করা হয়েছিল, তাও বর্তমানে মূল্য ছাড়ে বিক্রি করা হচ্ছে।  এমন পরিস্থিতিতে এ খাতে নতুন উদ্যোগ নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে সাইকেল ও সাইকেল যন্ত্রাংশ খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বাইসাইকেল একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রকার অসমধর্মী কাঁচামাল, স্পেয়ার, পার্টস ও কম্পোনেন্টসের সমন্বয়ে একটি জটিল প্রক্রিয়াজাত পণ্য, অন্যদিকে রফতানির বিপরীতে ব্যাপকসংখ্যক সনদ, লাইসেন্স ও অনুমতিপত্র সংগ্রহের প্রয়োজন। ফলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।’ এমন পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা কী জানতে চাওয়া হলে লুৎফুল বারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানি বাণিজ্যে ব্যাপক লাইসেন্সিং বা সনদ সম্পৃক্ততা একটি বয়বহুল প্রক্রিয়া বলে আমরা মনে করি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফ থেকে বাস্তবসম্মত নীতিগত সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন। অন্যথা এ খাতের আসন্ন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অসম্ভব।’    

সাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির মাধ্যমে যাত্রা হলেও পূর্ণাঙ্গ সাইকেল নিয়ে মেঘনা গ্রুপ দেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় নামে ১৯৯৩ সালে। সে বছর সরকারি মালিকানাধীন বিলুপ্তপ্রায় বাংলাদেশ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কিনে নিয়েছিল মেঘনা গ্রুপ। তাইওয়ান ও জাপান থেকে আনা হয় সাইকেল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সর্বোৎকৃষ্ট যন্ত্রপাতি। সেই সঙ্গে নেয়া হয় যথাযথ সংস্কারের উদ্যোগ। উৎপাদিত সাইকেল নিয়ে মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রির কর্তাব্যক্তিরা ‘তাইপে সাইকেল শো’, ‘ইউরো বাইক শো’, ‘ইন্টারবাইক ইন্টারন্যাশনাল বাইসাইকেল এক্সপো’ ইত্যাদি সাইকেলের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীগুলোয় অংশ নিতে থাকেন। স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারাগাছ তখন মাথা তুলেছে মাত্র।

১৯৯৯ সাল। ইতিহাস সৃষ্টি করে মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো ইউরোপের বাজারে সাইকেল রফতানি শুরু হয়। রফতানিতে জোয়ার আসে ২০০৭ সালে।

২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রথম প্রিমিয়াম সাইকেল স্টোর ‘সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ’-এর উদ্বোধন করে মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি। ২০১২ সালে ‘ভেলোচ বাইসাইকেলস’ নামে নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে মেঘনা গ্রুপ। পাশাপাশি সে বছর থেকেই স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোয়ও সাইকেল রফতানি শুরু করে।

পশ্চিমা বিশ্বে সুনাম অর্জন করে মেঘনা সাইকেল। ২০১৮ সালে জার্মানির বিখ্যাত ব্র্যান্ড ‘কিউব বাইকস’-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ব্র্যান্ডটির সাইকেল উৎপাদন শুরু করে মেঘনা গ্রুপ। বর্তমানে জার্মানির একটি বিশেষজ্ঞ দল এ ইউনিটের তত্ত্বাবধানে আছে। ২০২০ সালে তাইওয়ানের সর্বোৎকৃষ্ট ফ্রেম ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মেঘনা গ্রুপ বাংলাদেশে সাইকেলের কার্বন ফাইবার ফ্রেম উৎপাদনের একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। 

মেঘনা গ্রুপের সাইকেল উৎপাদনের কারখানাগুলো গাজীপুরে অবস্থিত। এসব কারখানায় মাউন্টেন বাইকস, বিএমএক্স বাইকস, রোড বাইকস, সিটি বাইকস, ট্যান্ডেম, ইলেকট্রিক বাইকস, চপার বাইকস ইত্যাদি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের সাইকেল উৎপাদিত হয়। প্রতি বছর নয় লাখ সাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা আছে কারখানাগুলোর। মেঘনা গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে বর্তমানে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, ফিনল্যান্ড, স্পেন ও ভারতে সাইকেল রফতানি করে এ গ্রুপ।

সাইকেল রফতানি প্রসঙ্গে মেঘনা গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার লুৎফুল বারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের রফতানি বাজার মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যকেন্দ্রিক।’ 

সাইকেল উৎপাদন ও রফতানিতে যে সময়টাতে মেঘনা গ্রুপের উত্থান ঘটছে, সেই সময়েই বাংলাদেশ থেকে সাইকেল রফতানিতে আরেক পথিকৃৎ হিসেবে যাত্রা হয় আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (বেপজা) থেকে নিবন্ধ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯৫ সালের মার্চ থেকে সাইকেল উৎপাদন শুরু করে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড। তাইওয়ানের নাগরিক ইয়ে চেং মিন এর প্রতিষ্ঠাতা। মালয়েশিয়ায় তার একটি সাইকেল তৈরির কারখানা ছিল। নাম ছিল ‘আকোকো’। একপর্যায়ে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। তখন কারখানায় কর্মরত কয়েকজন বাংলাদেশী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে কারখানা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন ইয়ে চেং মিন। এর অন্যতম কারণ ছিল বাংলাদেশের সহজলভ্য শ্রম।

সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের সাইকেল রফতানিতে নেতৃত্ব দেয়া আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের যাত্রা হয়েছিল মালয়েশিয়া থেকে আসা আট শ্রমিকের মাধ্যমে। তারা মূলত প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি সাইকেল তৈরির কারখানা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরির দুটি ইউনিট আছে। এগুলোয় চার শতাধিক শ্রমিক কর্মরত। চট্টগ্রাম ইপিজেডে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের কারখানা ও ইউনিট দুটি অবস্থিত। ৫ হাজার ৬৪৪ মিটার এলাকাজুড়ে এ কারখানা গড়ে তোলা হয়। বিনিয়োগ করা হয় ৪৭ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩০ ডলার। যন্ত্রাংশ তৈরির ইউনিট দুটির নাম ‘এইস বাইসাইকেল’। উভয় ইউনিটে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৯ লাখ ২৩ হাজার ১০৮ ডলার। আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের কারখানায় বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার সাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। বর্তমানে বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার সাইকেল উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। এটি সাধারণত ৬০-২৮০ ডলার মূল্যের ‘মাউন্টেনস ট্র্যাকিং বাইসাইকেল’ উৎপাদন করে। উৎপাদিত সাইকেলের ৯৮ শতাংশ ইউরোপে রফতানি হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই যায় যুক্তরাজ্যে। সাইকেল রফতানির ক্ষেত্রে এ কোম্পানির  প্রথম চালানটিও গিয়েছিল যুক্তরাজ্যেই। প্রথম চালানে তিনটি কনটেইনারে প্রায় এক হাজার সাইকেল রফতানি করেছিল আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড। হালফোর্ডস, রিস সাইকেল লিমিটেড, মন্টি বাইকস ইত্যাদি ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের হয়ে সাইকেল তৈরি করে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড। 

মেঘনা গ্রুপ ও আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের অনেক পরে যাত্রা করেও সাইকেল উৎপাদন ও রফতানিতে অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে চালান পাঠানোর মাধ্যমে সাইকেল রফতানি শুরু করেছিল এ কোম্পানি। বর্তমানে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামসহ মোট ১৫টি দেশে সাইকেল রফতানি করে আরএফএল গ্রুপ। ২০২২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সাইকেল রফতানির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এ প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া বাইক ম্যাগনেট, ফ্রেম, ফর্ক, টায়ার, টিউবসহ সাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশও রফতানি করে কোম্পানিটি।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সাইকেল তৈরির প্রথম কারখানাটি স্থাপিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এটি অবস্থিত। এ কারখানায় প্রতি বছর প্রায় আট লাখ সাইকেল উৎপাদিত হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রংপুরের গঙ্গাচরা উপজেলায় সাইকেল তৈরির দ্বিতীয় কারখানাটি স্থাপন করে আরএফএল গ্রুপ। প্রতি বছর ছয় লাখ সাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা আছে কারখানাটির। ৭০ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে অবস্থিত কারখানাটি নির্মাণে ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।  


লেখক: সাংবাদিক

আরও