চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ডেনিম রফতানিতে শীর্ষে বাংলাদেশ

বহু বছর ধরেই পোশাক রফতানিতে শক্ত অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে ডেনিম পণ্যের রফতানিতে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে। দেশটির রফতানি খাতের জন্য এটি এক বিরাট সাফল্য।

বহু বছর ধরেই পোশাক রফতানিতে শক্ত অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে ডেনিম পণ্যের রফতানিতে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে। দেশটির রফতানি খাতের জন্য এটি এক বিরাট সাফল্য।

বাংলাদেশ থেকে রফতানীকৃত তৈরি পোশাকের অন্যতম ডেনিম। বাংলাদেশী ডেনিমের প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে ইউরোপের প্রতি তিনজন গ্রাহকের একজন বাংলাদেশে তৈরি ডেনিমের পোশাক পরেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের ডেনিমের অবস্থান শীর্ষে। ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ইউরোপের বাজারে ডেনিম রফতানিকারক দেশ হিসেবে শীর্ষ স্থানটি ছিল চীনের দখলে। সে বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে ডেনিম রফতানির দিক থেকে চীনকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। আর ২০২০ সালে চীনকে টেক্কা দিয়ে মার্কিন মুলুকে ডেনিম রফতানিকারী শীর্ষ দেশের মুকুট পরে বাংলাদেশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের ডেনিম রফতানি বছরে ৪২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়ে ৭৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ইউএস অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটিএক্সএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ৫২ কোটি ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৩২৪ কোটি ডলারের ডেনিম কাপড় আমদানি করেছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি।

তরুণ ও যুবকদের মধ্যে তো বটেই, বৃদ্ধদের কাছেও ডেনিম পোশাকের কদর ক্রমে বাড়ছে। বৈশ্বিক এ ফ্যাশন ট্রেন্ডের দিকে লক্ষ্য রেখে ডেনিম পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ বাড়িয়েছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। ফলে তৈরি পোশাকের অন্তর্ভুক্ত বিশেষ খাতটিতে বিনিয়োগ বেড়েছে। ডেনিম খাতে তাদের বিনিয়োগ ও শ্রমের কারণে চলমান বৈশ্বিক সংকট সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ডেনিম খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ দেশে ৪০টি কারখানায় মাসে আট কোটি ইয়ার্ড ডেনিম পোশাক উৎপাদন হয়। বিশ্বের ডেনিম বাজারে বাংলাদেশের দখল প্রায় ২৫ শতাংশ। এ হার ক্রমে বাড়ছে। 

প্রথম দিকে ডেনিম কাপড় দিয়ে তৈরি প্যান্টকেই কেবল জিন্স বলা হতো। কালক্রমে জিন্স শব্দটিই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন ডেনিমের পরিবর্তে জিন্স শব্দটিই বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ডেনিমের জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে প্যান্টের পাশাপাশি ডেনিম কাপড় দিয়ে ছেলে ও মেয়েদের শার্ট ও জ্যাকেট, পাঞ্জাবি, মেয়েদের টপস, শিশুদের পোশাকও তৈরি হচ্ছে। ফ্যাশন সচেতন মানুষের হাতব্যাগ, কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, এমনকি পায়ের জুতায়ও জায়গা করে নিয়েছে ডেনিম কাপড়। 

বিশ্বে ডেনিমের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যেকোনো মৌসুমেই আরামদায়ক ডেনিমের পোশাক। টেকসই হওয়ার কারণে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে ডেনিম। তাই সারা বছরই এ কাপড়ের চাহিদা থাকে।

বাংলাদেশে ডেনিম পণ্য উৎপাদনের যাত্রা আশির দশকের একেবারে শেষের দিকে। বাংলাদেশে ডেনিমের বাজার সম্পর্কিত কয়েকটি সমীক্ষার তথ্য অনুসারে, ১৯৮৯ সালে প্রথম হংকং ও ফিলিপাইনের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ডেনিম পোশাক তৈরির দুটি কারখানা স্থাপন করে। ১৯৯২ সালের নভেম্বরেই বাংলাদেশ বিশ্বের ১১তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। টেস্টিং ও সার্টিফিকেশনের জন্য বাংলাদেশে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি আছে। 

বিশ্বে সবচেয়ে বড় পোশাক রফতানিকারী দেশ চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশটির অবস্থান সুবিধাজনক নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে টানা শুল্কযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য পতন ঘটেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য পোশাক রফতানিকারী দেশের জন্য সুযোগ বেড়েছে। চীন থেকে এসব পণ্যের ক্রয়াদেশ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো তাদের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি ডেনিম নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তা বাস্তবায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম রফতানি আরো বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ডেনিম আমদানিকারী শীর্ষ বায়ারদের মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম (সুইডেন), ইউনিক্লো (জাপান), টেসকো (যুক্তরাজ্য), ওয়ালমার্ট (যুক্তরাষ্ট্র), লিভাই’স (যুক্তরাষ্ট্র), ডিজেল (সংযুক্ত আরব আমিরাত), র‍্যাংলার (যুক্তরাষ্ট্র), জি-স্টার (নেদারল্যান্ডস), এস অলিভার (জার্মানি), হুগো বস (জার্মানি), গ্যাপ (যুক্তরাষ্ট্র), পিভিএইচ (যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস ভোগেলে (ইতালি), জ্যাক অ্যান্ড জোন্স (ডেনমার্ক), রিভার আইল্যান্ড (যুক্তরাজ্য), সিঅ্যান্ডএ (বেলজিয়াম) ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। 

বাংলাদেশে উৎপাদিত ডেনিম পণ্য গুণগত মানে আমদানিকারকদের মন জয় করেছে। সবুজ কারখানায় পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে ডেনিম পণ্য উৎপাদন করে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছে বাংলাদেশী ডেনিম এ কারণেও আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় বাজার। কিন্তু সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হোঁচট খেয়েছিল। পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক সংস্কার চালান উদ্যোক্তারা। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কভিড মহামারীর কারণে রফতানি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও দ্রুতই সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হন খাতসংশ্লিষ্টরা। গত এক দশকে এ দেশের ডেনিম খাতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে। এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত অনেক লন্ড্রি ওয়াশিং প্লান্ট স্থাপন এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিকাশ অন্যতম। ডেনিম তৈরিতে প্রয়োজনীয় ফ্যাব্রিক উৎপাদনের কারখানা বাংলাদেশে স্থাপন হয়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাট ও তুলা এবং একই রকম আঁশ জাতীয় দ্রব্যের সংমিশ্রণে সাশ্রয়ী মূল্যে সুতা উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। এ পদ্ধতিতে উন্নত মানের ডেনিম কাপড় তৈরি হয়। বাংলাদেশে পাট ও তুলার সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া সুতা ব্যবহার করে ডেনিম কাপড় তৈরি হয়। দেশে পাটের উৎপাদন বাড়িয়ে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং ডেনিমের বিশ্ববাজার ধরতেই পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ নিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে সম্পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থা হালনাগাদ করা হয়েছে। তাছাড়া শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং কম লিড টাইমের কারণেও বাংলাদেশী ডেনিম অগ্রাধিকার পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সামনে সারা বিশ্বে ডেনিম রফতানি সম্প্রসারণের বিশাল সুযোগ উন্মোচন হয়েছে।

ডেনিম রফতানিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে এ খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা অবকাঠামোগত দুর্বলতা। দক্ষ কারিগরের সংখ্যাও অপ্রতুল। মাঝারি মানের একটি ডেনিম কারখানা করতেও অন্তত ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এত টাকা একজন উদ্যোক্তার পক্ষে জোগান দেয়া কঠিন। ডেনিম খাতে পর্যাপ্ত ব্যাংকঋণও পাওয়া যায় না। আবার ঋণ পেলেও সুদের হার অনেক বেশি। ফলে প্রতিযোগিতায় টিতে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। একদিকে গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে, অন্যদিকে ক্রমাগত গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ফলে গ্যাস নিয়ে উদ্যোক্তারা বিপাকে আছেন। এসব কারণে চাহিদার তুলনায় দেশে ডেনিমের কারখানা অনেক কম। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কম সুদে ঋণ, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রত্যাশা উদ্যোক্তাদের। গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পেলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে ওই পণ্যের দাম বেড়ে যাবে এবং প্রতিযোগিতামূলক স্তরে রাখা যাবে না।

ডেনিম খাতের এসব চ্যালেঞ্জের প্রভাব পড়েছে ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে। আরএমজি বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিমের রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। 


লেখক: সাংবাদিক

আরও