রফতানিযোগ্য পোশাক তৈরির প্রধান উপাদান কাপড় হলেও এর বাইরেও আনুষঙ্গিক কিছু উপাদানের প্রয়োজন হয়। এসব আনুষঙ্গিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে বোতাম, জিপার, সুতা, লেভেল, মোটিফসহ ৪১ ধরনের পণ্য। কারখানায় কাপড় নেয়া থেকে শুরু করে পোশাক রফতানির সর্বশেষ ধাপ পর্যন্ত এ ৪১ ধরনের পণ্য ব্যবহৃত হয়। আশির দশকে এসব আনুষঙ্গিক পণ্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো। গত চার দশকে সেই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। ধীরে ধীরে আমদানি কমে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে দেশের পোশাক তৈরির আনুষঙ্গিক পণ্যের বাজার। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করা যাচ্ছে। দেশীয় উৎপাদনে আনুষঙ্গিক এসব পণ্যের বাজার দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি হয় প্রচ্ছন্ন রফতানি হিসেবে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার সরাসরি রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে বাংলাদেশে পোশাক তৈরির আনুষঙ্গিক পণ্য উৎপাদনের কোনো কারখানা ছিল না। তখন আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভর করে চলতে হতো। পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যগুলো আমদানি করে ব্যবহার করা হতো। যেমন কার্টন উৎপাদনের মতো স্থানীয় কোনো কারখানা দেশে ছিল না। তখন স্থানীয় উৎপাদনকারীরা তৈরি পোশাক রফতানির সময় পুরনো ও আগে ব্যবহৃত কার্টন ব্যবহার করতেন। রফতানির জন্য এসব পুরনো কার্টন আমদানি করতে হতো। আমদানীকৃত কার্টনগুলো পণ্য বহনের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী কেটে নিয়ে আবারো ব্যবহারের উপযোগী করা হতো।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক সময় রফতানির জন্য পণ্য প্রস্তুত থাকলেও সময়মতো চালান পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতো। মাত্র ১৫ বছর আগেও পোশাক শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গিক উপাদান বোতাম চীন ও হংকং থেকে কিনে আনতেন স্থানীয় উৎপাদকরা। বোতাম ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্যের স্বল্পতার কারণে অনেক পোশাক উৎপাদনকারী বিদেশী খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডের বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে তৈরি পোশাক রফতানি করতে ব্যর্থ হতেন। প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্য পাঠাতে না পারলে কখনো বড় আকারের মূল্য ছাড় দিতে হতো নতুবা অর্ডার বাতিলও হয়ে যেত।
এখন পরিস্থিতি বদলেছে। স্থানীয় উৎপাদকরা আনুষঙ্গিক পণ্যের কারখানা স্থাপন করতে শুরু করেন। উদ্যোক্তারা গত ১৫ বছরে এ খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তৈরি পোশাকের আনুষঙ্গিক পণ্য ও প্যাকেজিং শিল্পের উন্নয়ন করেছেন, যার মাধ্যমে দেশের পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয়তা পূরণ হচ্ছে এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী হচ্ছে। বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর বাইরেও রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় এ খাতের বিনিয়োগ রয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার।
এসব আনুষঙ্গিক পণ্যের মধ্যে অন্যতম হ্যাঙ্গার। হ্যাঙ্গার উৎপাদনের জন্য দেশে ১৪টি কারখানা রয়েছে। হ্যাঙ্গার উৎপাদনের পাশাপাশি রিইউজেরও ব্যবহার করেন অনেকেই। এমনই একটি কারখানা রয়েছে প্যাক্ট গ্রুপের। রিইউজের মাধ্যমে কোম্পানিটি যেমন পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রভাব কমায় তেমনি রফতানিও হয় এ খাতে।
প্যাক্ট গ্রুপের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. রফিকুজ্জামান বলেন, ‘হ্যাঙ্গার উৎপাদন করে প্রতি মাসে আমাদের টার্নওভার ২-৩ মিলিয়ন ডলার। এটা আমরা বাংলাদেশের কারখানা থেকেই সাপ্লাই করি। মূলত এ দেশের কারখানাগুলোই আমাদের পণ্য কেনে। এটা সরাসরি এক্সপোর্ট না, একে ডিএনডি এক্সপোর্ট (প্রচ্ছন্ন রফতানি) বলে। এছাড়া আমরা সরাসরি কিছু রফতানি করি। যেমন চীন, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কারখানাগুলো কিনে নেয় ৮০ শতাংশের বেশি পণ্য, বাকি ১০ শতাংশ আমরা রফতানি করি। আর কর্মসংস্থানের বিষয়ে যদি বলি তাহলে আমাদের এখানে এ মুহূর্তে ৭০০-৮০০ শ্রমিক কাজ করেন।’
পরিবেশের ওপর প্রভাব নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত সার্কুলার ইকোনমি ও টেকসই পণ্য নিয়ে কাজ করি। সার্কুলার ইকোনমি পরিবেশের ওপর থেকে নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি দূর করতে সক্ষম। হ্যাঙ্গারে প্রচুর প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার যত বেশি হয়, তত ল্যান্ড ফিল হয় এবং কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ে। আমাদের হ্যাঙ্গার প্রজেক্টটা মূলত রিইউজ প্রজেক্ট। একটা হ্যাঙ্গার যদি এখানে উৎপাদন হয়, তখন তৈরি পোশাকের সঙ্গে বিদেশে যায়, রফতানি হয়। আর যখন খুচরা বাজারে পোশাকটা বিক্রি হয়, তখন হ্যাঙ্গারটা আবার আমাদের কাছেই আসে। আমরা সেটিকে আবার প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করি। এভাবে একটি হ্যাঙ্গার অন্তত পাঁচবার ঘুরে। কারণ ৭০-৮০ শতাংশ হ্যাঙ্গার এ সাইকেলে আমাদের কাছে ফেরত আসে। আমরা দুভাবেই কাজ করি—একটা হচ্ছে নতুন পণ্য উৎপাদন, আরেকটা পুনর্ব্যবহার।’
৪০ বছর আগেও যে পণ্য আমদানি করতে হতো এখন তার রফতানি বাজারের সাইজ সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে মাত্র ২ হাজার ৭৫১ মিলিয়ন ডলার রফতানি করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছরই ৫০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার বাড়তে থাকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৫, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ১০০, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৭৫০, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬০০, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ হাজার ১২০, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭০০, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ হাজার ১০০, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৫০০, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ হাজার ৩০, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ হাজার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়।
এসব কারখানার মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ২৭টি, গাজীপুর ৩২৯, নারায়ণগঞ্জে ১৮৯ ও চট্টগ্রামে ২৮৩টি কারখানা রয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৭৪টি কারখানা রয়েছে।
তাদের এসব উদ্যোগে স্থানীয়দের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং বিলিয়ন ডলারের বিদেশী মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে। বর্তমানে প্রতিশ্রুত সময়সীমার মধ্যে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে, কারণ রফতানিকারকরা স্থানীয় বাজার থেকে সরাসরি আনুষঙ্গিক পণ্য ও কার্টন সংগ্রহ করতে পারছেন। বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে যে সময় নষ্ট হতো, তা আর এখন হচ্ছে না।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) তথ্যমতে, গার্মেন্ট পণ্য রফতানির আনুষঙ্গিক পণ্য তৈরিতে দেশে এখন দুই হাজারেরও বেশি কারখানা রয়েছে। গত এক দশকে নয় শতাধিক কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের ২১ দেশে রফতানি হয়। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, জার্মানি, স্পেন, পাকিস্তান, চীন, মিসর, ইথিওপিয়া, আরব আমিরাত ইত্যাদি। তবে এ খাতের রফতানি সরাসরি হয় না। গার্মেন্ট পণ্যের সঙ্গে রফতানীকৃত এসব পণ্যকে প্রচ্ছন্ন রফতানি বলে। বর্তমানে এ খাতের প্রচ্ছন্ন রফতানির পরিমাণ ৭ বিলিয়ন ডলার। আর সরাসরি রফতানি হয় বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
বিজিএপিএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন মতি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আনুষঙ্গিক পণ্যের এ খাত দেশের সম্ভাবনাময় খাতের একটি। পৃথিবীতে আরএমজি সেক্টরের চেয়ে এর আনুষঙ্গিক খাতের বাজার বড়। এ খাতে আমরা রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। শুধু আমাদের একার পক্ষে রফতানি বাড়ানো সম্ভব নয়। এজন্য সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন, তাহলে আমরা আরো বেশি কাজ করতে পারব। এরই মধ্যে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে কথা বলেছি। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা আমাদের দেয়া হচ্ছে। এ খাতের রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলে বাংলাদেশকে আনুষঙ্গিক পণ্যের আন্তর্জাতিক হাবে রূপান্তর করতে পারব।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার এরই মধ্যে কিছু নীতিসহায়তা আমাদের দিচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত আমদানি, করপোরেট ট্যাক্স ৩০ থেকে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। এখন বন্ড ম্যানেজমেন্ট আপগ্রেড করা, ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদের সময়সীমা বৃদ্ধিসহ আরো কিছু বাণিজ্যিক সুবিধার প্রস্তাব সরকারের কাছে দেয়া আছে। এসব সুযোগ-সুবিধা পেলে এ খাতকে আরো বড় করা সম্ভব।’
নতুন বাজার খোঁজার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা করছি। নতুন বাজার খোঁজা বেসরকারিভাবে আমাদের একার পক্ষে সম্ভব না। তার জন্য কিছু সহায়তা প্রয়োজন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এ নতুন বাজার খোঁজা গেলে আমরা ভালো করতে পারব। নতুন বাজার খোঁজার কাজ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে করতে হবে।’
কী কী পণ্য উৎপাদন হয়: বাংলাদেশ থেকে ৪১ ধরনের পণ্য রফতানি হয়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ব্যাক প্যাচ, বোতাম, ঢেউতোলা শক্ত কার্টন, রাসায়নিক, ইলাস্টিক, পিইউ প্যাচ, ডস্টিং, এমব্রয়ডারি, গাম টেপ, ঝুলানো ট্যাগ, হ্যাঙ্গার, ইন্টারলাইনিং, প্যাকেজিং, প্রিন্টিং, কাগজের বাক্স, পলি ব্যাগ, পিপি ব্যান্ড, লেবেল, কুইলন্টিং, প্যাডিং, রেসিন, নিরাপত্তা ট্যাগ, ফিতা, সুইং থ্রেড, জিপারসহ নানা পণ্য।
আরএমজি খাতে সারা বিশ্বের অর্থনীতির আকার ৬০০ বিলিয়ন ডলার। আর আনুষঙ্গিক পণ্যের অর্থনীতির আকার ৮০০ বিলিয়ন ডলার। আনুষঙ্গিক পণ্য পোশাক খাতের অংশ হলেও পোশাক খাতের বাইরেও সব জায়গায় এসব পণ্যের ব্যবহার হয়। প্যাকেজিং, ফাস্ট ফুড, সিরামিক, ওষুধ, মাছ, সবজিসহ নানা ধরনের পণ্য রফতানিতে এসব পণ্য ব্যবহার হয়। এ কারণে এর চাহিদার আকারও আরএমজি থেকে বড়।
ইপিজেডগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগ আছে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। ইপিজেডের বাইরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে আনুষঙ্গিক খাতে। বৈশ্বিক মন্দার কথা জানিয়ে মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন মতি বলেন, ‘আনুষঙ্গিক পণ্যের ব্যবসা প্রধানত আরএমজি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বৈশ্বিকভাবে আরএমজি খাতের নিম্নমুখী রফতানির কারণে আমাদেরও রফতানি কমে গেছে। কভিড-উত্তরকালে আমাদের ব্যবসা এক বছর ভালো চলেছিল। কিন্তু তার পর থেকে আরএমজি সেক্টরের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়ও মন্দা দেখা দেয়। গত এক বছরে আমাদের ব্যবসায় ১০-১৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
চীন থেকে পণ্য আমদানি কমানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো ডলার সংকট। আমরা ডলার বাঁচানোর জন্য একটা চিন্তা করছি। চীন থেকে প্রতি বছর আমরা ১ বিলিয়ন ডলারের আনুষঙ্গিক পণ্য আমদানি করি। চীনের এ পণ্য আমদানি বন্ধ করা গেলে একদিকে যেমন আমাদের ডলার সেভ হবে অন্যদিকে আমাদের স্থানীয় পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানো সম্ভব হবে।’