বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির শুরুটা হয় ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রিয়াজ গার্মেন্টসের পাঠানো প্রথম চালানে ছিল ওভেন পোশাক। ১০ হাজার পিস শার্টের রফতানি গন্তব্য ছিল ফ্রান্স।
আশির দশকে শার্ট ও প্যান্টের মতো ওভেন পোশাকই ছিল প্রধান রফতানি পণ্য। ওই সময় মোট রফতানিতে ওভেন গার্মেন্টের অংশ ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। এরপর ধীরে ধীরে নিট পোশাকেও সক্ষমতা তৈরি হয় বাংলাদেশের। পর্যায়ক্রমে মোট রফতানিতে ওভেন ও নিট গার্মেন্টের অংশগ্রহণে আসে সমতা। তবে গত এক দশকে এ চিত্র বদলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রান্তিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট রফতানিতে ওভেন পোশাকের অংশ কমছে, বাড়ছে নিটওয়্যারের।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের প্রায় ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। এর আগের অর্থবছর এ পরিমাণ ছিল ৮২ শতাংশের কিছু কম। ধরন বিবেচনায় পোশাক মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—ওভেন গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার। মোটাদাগে টি-শার্ট, পোলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টসকে বলা হয় নিটওয়্যার। অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম জিন্স ওভেন পোশাক হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় গত আট অর্থবছরে মোট রফতানিতে ওভেন পোশাকের অংশ কমলেও বেড়েছে নিটওয়্যারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাকের মোট রফতানি আয়ে নিটের অংশ ছিল ৫৪ শতাংশের বেশি। ওভেনের অবদান ছিল ৪৬ শতাংশের কিছু কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ৫৩৮ কোটি ডলারের নিট পোশাক রফতানি হয়েছে। একই সময়ে ওভেন রফতানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১২৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে পোশাক রফতানিতে নিট ও ওভেনের ব্যবধান আরো বেড়েছে। এ সময় নিটের রফতানি ২২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে ওভেনের রফতানি বাড়ার পরিমাণ প্রায় ১২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৫ হাজার ২২৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৮৪৩ কোটি ডলার আর ওভেনে ২ হাজার ৩৮৪ কোটি ডলার।
‘কোয়ার্টারলি রিভিউ অন রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি): জুলাই-সেপ্টেম্বর অর্থবছর ২০২১-২২’ শীর্ষক পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরেও মোট রফতানিতে ওভেনের অংশগ্রহণ কম ছিল। গত অর্থবছরে মোট রফতানির অর্থমূল্য ছিল ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। রফতানির ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ ছিল তৈরি পোশাক। এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ ছিল ওভেন গার্মেন্টস। নিটওয়্যারের অংশ ছিল ৪৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত তিন অর্থবছরে পোশাক রফতানিতে ওভেনের তুলনায় নিটের অবদান বেড়েছে। তবে তার আগের চিত্র ছিল ভিন্ন। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও নিটের চেয়ে ওভেনের রফতানি ১৩ কোটি ডলার বেশি ছিল। আগের অর্থবছরগুলোতে এ ব্যবধান আরো বেশি ছিল। পোশাক রফতানির শুরু থেকেই ওভেনের অংশ বেশি ছিল। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ১২০ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছিল। বিপরীতে নিট রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ কোটি ডলার।
মোট রফতানিতে নিট পোশাকের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চিত্রটি স্বাভাবিক ধারা বলে মনে করছেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত, অনেক দিন ধরেই নিট পোশাকের অংশ বাড়ছিল। যদিও শুরুটা ছিল ওভেন পোশাকের হাত ধরে। ওভেনের অংশ কমে যাওয়া এবং নিট পোশাকের বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ঘটেছে পর্যায়ক্রমে ধীরগতিতে। যার মূল কারণ নিট পোশাকের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সক্ষমতা। স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত থাকাটা অনেক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া নিট পোশাকের হাল ফ্যাশন খুব দ্রুতগতির।
ক্রেতারা দ্রুত ক্রয়াদেশ নিতে চাচ্ছেন—এমন তথ্য উল্লেখ করে পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, ফাস্ট ফ্যাশনের চাহিদা ওভেন পোশাকের চেয়ে নিট পোশাক শিল্প বেশি মেটাতে পারছে। নিট পোশাকের সুতা-কাপড়ের সিংহভাগ যেহেতু স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়, তাই এটা সম্ভব হচ্ছে। ওভেনের ক্ষেত্রেও কাঁচামালের স্থানীয় সক্ষমতা আছে কিন্তু এখনো বড় একটি অংশ আমদানিনির্ভর রয়ে গেছে। ফলে ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ দ্রুত সরবরাহ করাটা নিট পোশাকের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব, ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আবার ওভেনের তুলনায় নিটের স্থানীয় মূল্য সংযোজন বেশি হয়। বর্তমানে নিটের মূল্য সংযোজন প্রায় ৯০ শতাংশ। ফলে আমদানিও কম করতে হয়। অন্যদিকে ওভেনের মূল্য সংযোজন ৪০ শতাংশের মতো। এ খাতের ৬০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। ওভেনের ক্ষেত্রে লিড টাইমের সুবিধাও কম।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্রেতাদের কাছে নিট পোশাকের জন্য বাংলাদেশ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য, কারণ কাঁচামাল উৎপাদন সক্ষমতা। কভিড প্রেক্ষাপট ছাড়া নিট ও ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের ব্যবহার বা ক্রয় আচরণে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে নিট পোশাকের ধরন বা বৈচিত্র্য অনেকটা বেড়েছে, ফলে ভোক্তাদের পোশাক ব্যবহারের যে ধারা সেখানে কিছুটা পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। আবার ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে কাঁচামাল উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় ওভেন গার্মেন্টের জন্য ভিয়েতনাম বা পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখছে। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের মোট রফতানিতে নিট পোশাক ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছিল ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলারের পণ্য। অর্থমূল্য বিবেচনায় ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। যার ৪৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ রফতানি হয় ওভেন গার্মেন্টস। বাকি ৩৯ শতাংশ পোশাক ছিল নিটওয়্যার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। অর্থমূল্য বিবেচনায় এসব পণ্যের ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। এর মধ্যে ৪২ দশমিক ৫৪ শতাংশই ছিল ওভেন গার্মেন্টস। আর নিটওয়্যার ছিল ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ থেকে তিন বছরের ব্যবধানেই মোট রফতানিতে ওভেনের অংশ কমে যায়। অন্যদিকে নিটওয়্যারের অংশ বেড়ে যায়।
ওভেনের অংশ কমে নিটওয়্যারের অংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৮-১৯-এর পরও। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়, যার ৮৩ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। ৪১ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল ওভেন গার্মেন্টস। ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ ছিল নিটওয়্যার।
জানা গেছে, বিশ্ববাজারে নিটের তুলনায় ওভেন পোশাকের দাম বেশি। নিটের চেয়ে ওভেন পোশাকে মূল্য সংযোজনও কম। ওভেন পোশাকের কাঁচামালের একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়। নিটের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাপড় দেশীয় কারখানা জোগান দেয়। যা ধীরে হলেও বাংলাদেশের পোশাক রফতানির সক্ষমতার চিত্রে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এছাড়া কভিড মহামারীর অভিঘাতের ফলেও ওভেনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে নিট।
লেখক: সাংবাদিক