ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পোশাক তৈরির একমাত্র মাধ্যম ছিল দর্জিদের হাতে বানানো পোশাক। রাজধানীর উর্দু রোড এলাকায় বিখ্যাত সব দর্জির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। ব্যক্তিকেন্দ্রিক পোশাক ব্যবসার চিত্র পাল্টাতে শুরু করে এ অঞ্চলের স্থানীয় কিছু মানুষের প্রচেষ্টায়। প্রথমদিকে এক সঙ্গে অনেক জামাকাপড় তৈরি করে তা রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাইকারি মূল্যে পৌঁছে দিতেন ব্যবসায়ীরা। তাদের একজন রিয়াজউদ্দিন। উর্দু রোডের এক প্রান্তে রিয়াজ স্টোর নামে দোকান ছিল তার। দেশের নানা প্রান্তে পাইকারি হিসেবে পোশাক পৌঁছে দিত রিয়াজ স্টোর। এভাবেই দিন চলছিল তার।
বাবার মুখ থেকে রিয়াজ স্টোরের এসব গল্প শুনেছেন ছেলে মো. সালাউদ্দিন। তিনি এখন টেক্সটাইল খাতের জ্ঞান বিনিময় প্লাটফর্ম বুননের হেড অব অপারেশনের দায়িত্ব পালন করছেন। বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা আটটি সেলাই মেশিন নিয়ে সেলাই দোকান শুরু করেন। আস্তে আস্তে দেশীয় মার্কেটে বাবা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করলাম; রিয়াজ শার্ট, রিয়াজ প্যান্ট খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল তখন। বাবার গল্পের মোড় ঘোরে করাচির এক কারখানা দেখে। ১৯৬৫ সালে করাচি গিয়ে তিনি দেখেন, পশ্চিম পাকিস্তানের এক পোশাক কারখানা বিদেশে পোশাক রফতানি করছে। সেখান থেকে তিনি উৎসাহ পেলেন, দেশে আসার পর ১৯৬৯ সাল থেকে গার্মেন্টস পণ্য বিদেশে রফতানির একটা প্রচেষ্টা করেন তিনি। তার অংশ হিসেবে চাঁদফেরত নীল আর্মস্ট্রংয়ের দল যখন বাংলাদেশে আসে তখন রিয়াজ গার্মেন্টসের পণ্য তাদের উপহার দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার পাঠান তারা।’
সালাহউদ্দিন জানান, রফতানির চিন্তা থেকে ১৯৭২ সালে রিয়াজ স্টোরের নাম পরিবর্তন করে রিয়াজ গার্মেন্টস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ দেশে বেশ সুনাম অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় বাজারে রিয়াজ শার্ট হয়ে ওঠে জনপ্রিয় এক ব্র্যান্ড। তখন তিনি কিছু শার্ট নিয়ে ট্রেডিং করপোরেশন (অব) বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছে উপস্থাপন করেন।
১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ওভেন পণ্য নিয়ে প্রথম সে রফতানি চালানের গন্তব্য ছিল ফ্রান্স। ১০ হাজার পিস শার্টের ওই চালানের মোট মূল্য ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ফ্রাঁ। লেনদেন হয়েছিল জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ছিল হল্যান্ডার ফ্রান্স।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘পোশাক রফতানির ভিত তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমার পিতা। তার নেতৃত্ব দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছি। দেখেছি পোশাক খাতের অনেক উত্থান ও পতন। দেশের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প। আজ পোশাক শিল্পের স্বপ্নদ্রষ্টার সন্তান হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’
এসময় দেশে রফতানিমুখী পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন এম নুরুল কাদের। মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক এ সরকারি কর্মকর্তা রফতানিমুখী পোশাক কারখানা দেশ গার্মেন্টস গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ী জীবন শুরু করেন তিনি। এটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় ১৯৭৭ সালে। প্রকল্পটি গড়ে উঠছিল কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির সহযোগিতা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে। কারখানাটির ৭৫ শতাংশ কাঁচামালই সে সময় আমদানি করতে হতো। আশির দশকের প্রথমার্ধে তখন সরকারি তহবিলে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট। দেশ গার্মেন্টসের কাঁচামাল আমদানির বার্ষিক অনুমোদন ছিল ১৮ কোটি টাকার। কিন্তু সংকটের কারণে মাত্র ২৪ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানির লাইসেন্স পান এম নুরুল কাদের। ফলে প্রায় দুই বছর তাকে কাঁচামালের অভাবে বিশাল লোকসানে পড়তে হয়। যদিও দেশ গার্মেন্টসে পোশাক তৈরির ক্রয়াদেশ গ্রহণের মতো যথেষ্টসংখ্যক বিদেশী ক্রেতার নিশ্চিতকৃত এলসি বা ঋণপত্র ছিল। সংকট কাটাতে মরিয়া এম নুরুল কাদের বিদেশী ক্রেতার ঋণপত্র বন্ধক রেখে কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার প্রস্তাব দেন। নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে অনেক আলোচনা ও দরকষাকষির পর বিষয়টির যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন তিনি।
দেশ গার্মেন্টস যাত্রা করার পর একপর্যায়ে এ খাতে এগিয়ে আসেন আরো কয়েকজন উদ্যোক্তা। তবে ১৯৮০-৮১ সালের আগ পর্যন্ত এ শিল্পের কারখানার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। গোটা আশির দশকজুড়েই বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল তৈরি পোশাক খাত। ওই দশকের শেষ পর্যন্ত শিল্পটির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় চালকের ভূমিকায় ছিলেন রিয়াজউদ্দিন ও এম নুরুল কাদের। গোটা দশকেই তৈরি পোশাক রফতানির পথকে মসৃণ করতে অক্লান্ত শ্রম দিতে হয়েছিল তাদের দুজনকে।
রিয়াজউদ্দিনের প্রথম রফতানি আদেশ ছিল ওভেন পোশাকের। ওভেন পোশাকের কাপড় তৈরিতে দুই বা ততোধিক সুতা সেট ব্যবহার করা হয়। এসব সুতা একে অন্যের সঙ্গে সমকোণে অবস্থান করে। এসব কাপড় অনেক বেশি টেকসই হয়। পৃথিবীতে নানা ধরনের ওভেন কাপড় দেখা যায়। এর মধ্যে দেশে বহুল ব্যবহৃত ওভেন ফ্যাব্রিকের মধ্যে রয়েছে ডেনিম ফ্যাব্রিক, গ্যাবার্ডিন ফ্যাব্রিক, চিজ ক্লথ, বুক্রাম ফ্যাব্রিক, কাশ্মীর সিল্ক ফ্যাব্রিক, মালমাল ফ্যাব্রিক, লিনো ফ্যাব্রিক, মাদ্রাজ মুসলিম নেট ফ্যাব্রিক, শিফন ফ্যাব্রিক, চিংজৎ ফ্যাব্রিক প্রভৃতি।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। ধরন বিবেচনায় পোশাক মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—ওভেন গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার। মোটা দাগে টি-শার্ট, পোলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টসকে বলা হয় নিটওয়্যার। অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম জিন্স ওভেন পোশাক হিসেবে পরিচিত।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওভেন পোশাক খাতে রফতানি হয়েছে ২ হাজার ১২৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৯৩৯ কোটি ডলার রফতানি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওভেন পোশাকের তুলনায় নিট পোশাক রফতানি বেশি হয়েছে। এ সময় নিট পোশাক রফতানি হয় ২ হাজার ৫৭৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১০.৮৭ শতাংশ বেশি। এর আগের বছর ২ হাজার ৩২১ কোটি ডলার নিট পোশাক রফতানি হয়।
কোয়ার্টারলি রিভিউ অন রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়কালে মোট রফতানির ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। এর মধ্যে ৪৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ নিট পোশাক এবং ৪০ দশমিক ১০ শতাংশ ওভেন পোশাক রফতানি হয়। গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়ামসহ ৮০টিরও বেশি দেশ।
ওভেনের হাত ধরেই এ দেশে পোশাক রফতানির শুরু। প্রথম থেকে একচেটিয়া বাজার ছিল ওভেন পোশাকের। এই তিন দশকের যাত্রায় ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিটওয়্যার পোশাক। ২০০৭ সালে বাজারে ওভেন পোশাকের আধিপত্য প্রথমবারের মতো ছাড়িয়ে যায় নিটওয়্যার পোশাক। তারপর টানা পাঁচ বছর ওভেনের চেয়ে নিটওয়্যারের রফতানি বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি আবারো পরিবর্তন হয় ২০১৩ সালে। সে বছর আবারো ওভেন পোশাকের রফতানি বেড়ে যায়। তবে বাজার এবার একচেটিয়া ছিল না। সমতা বিধান করে রফতানি হতে থাকে দুই ধরনের পোশাক। ২০২০ সালের পর থেকে ফের নিটওয়্যারের চাহিদা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০২২ সালে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি রফতানি হয় নিটওয়্যার পোশাক।
লেখক: সাংবাদিক