নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাকিব রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইইই বিভাগ থেকে বের হয়ে ২০২১ সালে যোগ দেন গুগলের আইটি বিভাগের চাকরিতে। একই বছর গুগলের অ্যাকাউন্ট স্ট্র্যাটেজিস পদে যোগ দেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের গ্র্যাজুয়েট মো. ফুয়াদ হাসান। গত বছর অ্যামাজনে যোগ দিয়েছেন ইস্ট ওয়েস্টের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের অ্যালামনাই জহিরুল ইসলাম। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাকরি পাওয়ার এমন খবর এখন প্রায় শোনা যায়। গ্র্যাজুয়েটদের এমন গুণগত কর্মসংস্থানে দেশ-বিদেশে বেশ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে নর্থ সাউথ, ব্র্যাক ও ইস্ট ওয়েস্টের মতো সামনের সারির বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দেশ-বিদেশে এরই মধ্যে এমন নানা স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে সুপ্রাচীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম অবস্থানে জায়গা পেতে দেখা গেছে অপেক্ষাকৃত নবীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে। অনেক র্যাংকিংয়ে আবার পাবলিকের তিন-চার গুণ বেশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে।
টিএইচই প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৩’-এ বাংলাদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এসেছে। প্রথমবারের মতো টিএইচই র্যাংকিংয়ে জায়গা পেয়ে একই অবস্থান অর্জন করা শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশসেরার স্থানে ভাগ বসিয়েছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। আর কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংস ২০২৩-এ বাংলাদেশ থেকে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা পায়, যার দুটিই বেসরকারি। অর্থাৎ এখানেও সম অবস্থান। আর কিউএসের এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৩-এ বাংলাদেশী ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়। এর মধ্যে নয়টিই বেসরকারি খাতের।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষায় সামনের সারির কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করলেও গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এখনো সংকট-সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান। তবে এসব সংকট ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলে সামনের দিনে অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
১৯৯২ সালে সংসদে আইন পাস করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া শুরু করে সরকার। মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাত্রা হলেও দেশে এখন বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০৯টি। গত তিন দশকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত খাত ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আরো কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব জমা পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।
বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার উত্থান ও প্রসারের ওপর গবেষণা করে ২০০৭ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ও ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এডুকেশনাল প্ল্যানিং (আইআইইপি)। ‘প্রাইভেট হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চাকরিকেন্দ্রিক কোর্স চালু করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ তৈরি হয়। এছাড়া নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি খাতের গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান হয় দ্রুত এবং তাদের বেকার থাকতে হয় কম। এছাড়া প্রাইভেট থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা চাকরিতেও পাবলিকের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি বেতন পান।’
ব্যানবেইস ও ইউজিসির বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চালুর পর খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা। ১৯৯২ সালে আইন অনুমোদনের পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশে ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যাও। ১৯৯৭ সালে ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৬৬৮ জন শিক্ষার্থী ও ৬৩৬ জন শিক্ষক ছিলেন। ২০০০ সালে তিনটি বেড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯-এ। আর শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংখ্যা বেড়ে হয় যথাক্রমে ৩২ হাজার ৭৯১ ও ১ হাজার ৬০৮। অর্থাৎ ১৯৯৭ থেকে ২০০০—এই তিন বছরে দেশের বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪৭৯ শতাংশ। একই সময়ে শিক্ষকসংখ্যা বেড়েছে ১৫৩ শতাংশ। পরবর্তী সময়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে ঈর্ষণীয় হারে। এর মধ্যে ২০১০ সালে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৭৫২। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের দিকে এসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়ায়। তবে ২০২১ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রভাব পড়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমে ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হয়। সম্প্রতি সেমিস্টারগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি ফের বাড়তে শুরু করেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণার মানে আরো বেশি জোর দেয়া উচিত বলে মনে করেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রসারের দিক থেকে গত তিন দশকে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষা বেশ সফল। তবে এখন মানে জোর দেয়াটা বেশ জরুরি। এক্ষেত্রে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে দক্ষ ব্যক্তিদের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। কারণ দেশের বেসরকারি খাতের সফলতা দেখে কিছু বিদেশী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন পেয়েছে। আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আসতে চায়। এতে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে। তাই এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত।’