পরিকল্পিত নগরায়ণ, উন্মুক্ত স্থান, সবুজের আচ্ছাদন ও মানসম্মত যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয়ের একটি বাসযোগ্য শহর গড়ে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকার বেলায় এর কোনোটিই যথাযথ মানের জায়গায় নেই। এখানে নেই পর্যাপ্ত আবাসন, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, হাঁটার পার্ক, বেড়ানোর জায়গা। ফলে ঢাকায় বাসযোগ্যতার অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৬৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি ১০৯ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এবং ঢাকা উত্তর সিটি ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এতটুকু জায়গার মধ্যে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। জনঘনত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শহর এ ঢাকা। জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে সপ্তম বৃহত্তর শহরও আমাদের ঢাকা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চাকরির প্রয়োজনে সারা দেশের মানুষ ঢাকায় অভিবাসী হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতিদিন দুই হাজার মানুষ নতুন করে ঢাকায় অভিবাসী হচ্ছে।
এত বিশালসংখ্যক
মানুষের যাতায়াতের
জন্য পর্যাপ্ত
ও মানসম্মত
গণপরিবহন অত্যন্ত
জরুরি। ঢাকায়
রাস্তা আছে
৭ থেকে
৮ শতাংশ,
যেখানে একটি
পরিকল্পিত শহরের
২৫ শতাংশ
রাস্তা থাকা
প্রয়োজন। বাংলাদেশ
সড়ক পরিবহন
কর্তৃপক্ষের তথ্য
অনুযায়ী চলতি
বছরের নভেম্বর
পর্যন্ত সারা
দেশে ৫৫
লাখ ৪৬
হাজার ৫১৭টি
মোটরযান নিবন্ধিত
এবং ঢাকা
মেট্রোতে ১৯
লাখ ৪৫
হাজার ১৩৪টি
মোটরযান নিবন্ধিত।
ঢাকার যানজট
নিরসনে বিভিন্ন
সংস্থা, যেমন
সিটি করপোরেশন,
ঢাকা পরিবহন
সমন্বয় কর্তৃপক্ষ,
বাংলাদেশ সড়ক
পরিবহন কর্তৃপক্ষ,
বাংলাদেশ সড়ক
পরিবহন করপোরেশন,
ঢাকা মাস
ট্রানজিট কোম্পানি
লিমিটেড, রাজধানী
উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ,
ঢাকা মেট্রোপলিটন—ট্রাফিক
বিভাগ গণপরিবহন
পরিকল্পনা ও
বাস্তবায়নে কাজ
করছে। তাছাড়া
বাংলাদেশ রেলওয়ের
রেল পরিবহন
এবং বাংলাদেশ
আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন
কর্তৃপক্ষের নৌ-পরিবহনের
কাজ করছে।
সংশোধিত কৌশলগত
পরিবহন পরিকল্পনা
(২০১৫-২০৩৫)
অনুযায়ী পাঁচটি
মাস র্যাপিড
ট্রানজিট (এমআরটি
১, ২,
৪, ৫
ও ৬),
দুটি বাস
র্যাপিড ট্রানজিট
(বিআরটি ৩
ও ৭),
তিনটি রিং
রোড (ইনার,
মিডল ও
আউটার), আটটি
রেডিয়াল সড়ক
এবং ছয়টি
এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে।
উত্তরা থেকে
কমলাপুর পর্যন্ত
মেট্রোরেল-৬-এর
সর্বমোট দৈর্ঘ্য
২১ দশমিক
২৬ কিমি।
মেট্রোরেলের উত্তরা
থেকে আগারগাঁও
পর্যন্ত ১১
দশমিক ৭৩
কিলোমিটার দৈর্ঘ্য
নির্মাণকাজ এরই
মধ্যে সম্পন্ন
হয়েছে এবং
আগারগাঁও থেকে
কমলাপুর পর্যন্ত
৯ দশমিক
৫৩ কিলোমিটার
দৈর্ঘ্য নির্মাণকাজ
চলমান রয়েছে।
আশার আলো
যে মেট্রোরেল-৬
চালুর পর
প্রতি ঘণ্টায়
৬০ হাজার
যাত্রী পরিবহন
করতে পারবে
এবং সময়
ও কর্মঘণ্টা
সাশ্রয় হবে।
পরিবেশসম্মত গড়
গতি বৃদ্ধির
জন্য মেট্রোরেলের
মতো পরিবেশসম্মত
গণপরিবহন প্রকল্পগুলো
দ্রুত বাস্তবায়ন
প্রয়োজন, যাতে
২০৩০ সালের
মধ্যে জাতিসংঘের
টেকসই উন্নয়ন
লক্ষ্যমাত্রা এবং
২০৪১ সালে
উন্নত বাংলাদেশ
গড়ার প্রেক্ষিত
পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১)
পূরণে সহায়ক
হয়। তবে
মেট্রোরেল স্টেশনগুলোতে
যাত্রীরা স্টেশনে
নামার পর
প্রশস্ত ফুটপাথ
থাকা প্রয়োজন
এবং গণপরিবহনের
মাধ্যমে দূর
গন্তব্যে যাওয়ার
জন্য ট্রানজিট
ওরিয়েন্টেড উন্নয়ন
প্রয়োজন। ঢাকা
রাস্তার স্বল্পতার
কথা চিন্তা
করে ভবিষ্যতে
মাটির নিচ
দিয়ে সাবওয়ে
নির্মাণ করা
যেতে পারে।
ঢাকা শহরের
যানজট নিরসনে
প্রয়োজন গণপরিবহনের
সঠিক পরিকল্পনা
করা। শুধু
পরিকল্পনা করলেই
হবে না
সে পরিকল্পনার
যথাযথ বাস্তবায়নও
নিশ্চিত করতে
হবে। তাছাড়া
প্রয়োজন ঢাকার
উন্নয়নের সঙ্গে
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে
রাখা। সেজন্য
প্রয়োজন জনঘনত্ব
পরিকল্পনা ও
Neighborhood Development অর্থাৎ
একই এলাকার
মধ্যে আবাসিক
এলাকার পাশাপাশি
প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক
এলাকা, স্কুল,
সামাজিক অনুষ্ঠান
কেন্দ্র, প্রাথমিক
স্বাস্থ্য কেন্দ্র,
পার্ক-খেলার
মাঠ অন্যান্য
সুবিধাদি বিদ্যমান
থাকা। যাতে
করে নিত্যপ্রয়োজনীয়
কাজে দূরে
কোথাও যেতে
না হয়।
এর সঙ্গে
সঙ্গে জনবান্ধব
ও পরিবেশবান্ধব
টেকসই গণপরিবহন
ব্যবস্থাকে গুরুত্ব
দিয়ে সুষম
উন্নয়নের মাধ্যমে
সুন্দর, পরিবেশবান্ধব
ও উন্নত
ঢাকা নগরী
গড়ে তোলা
আমাদের সংকল্প
হোক।
ঢাকার যানজট
সমস্যা নিরসন
ও বাসযোগ্যতা
ফিরিয়ে আনার
জন্য কাজ
করছে দক্ষিণ
সিটি করপোরেশন।
এ লক্ষ্যে
আমরা ঢাকার
খালগুলো সচল
করে নৌপথ
চালু করার
পরিকল্পনা করছি।
বুড়িগঙ্গার আদি
চ্যানেল উদ্ধারের
কাজ এখন
দৃশ্যমান। কিছুদিন
পরই এ
পথে যাত্রীবাহী
ও পণ্যবাহী
নৌযান চলাচল
করবে। আমরা
ঢাকা নিয়ে
৩০ বছর
মেয়াদি সমন্বিত
মহাপরিকল্পনা করছি।
এখানে সুপরিকল্পিতভাবে
ঢাকার ভূমি
উন্নয়ন নিয়ে
কাজ করা
হবে। আমরা
কামরাঙ্গীরচরে নতুন
বাণিজ্যিক এলাকা
গড়ে তুলব।
এখানে ৫০
তলাবিশিষ্ট একটি
আন্তর্জাতিক মানের
বাণিজ্যিক হাব
হবে। কামরাঙ্গীরচরে
ছয় লেনের
রাস্তা হবে।
অদূর ভবিষ্যতে
গাবতলী থেকে
আন্তঃজেলার গাড়ি
যেন ঢাকায়
ঢুকতে না
হয়, সরাসরি
গাবতলী হয়ে
কামরাঙ্গীরচরের রাস্তা
দিয়ে বেরিয়ে
যাবে। এমনিভাবে
নানা প্রকল্প
নিয়ে দক্ষিণ
সিটির কাজ
এগিয়ে যাচ্ছে।
মেট্রোরেল হওয়ার
ফলে ঢাকা
দক্ষিণ সিটির
পরিকল্পনায় মেট্রোরেল
বেশ গুরুত্ব
পাচ্ছে। মেট্রোরেলে
যাত্রীদের নানা
সুবিধার কথা
বিবেচনায় নিয়ে
আমরা শহর
সাজানোর পরিকল্পনা
করছি। যেহেতু
আমাদের সড়ক
কম, আমাদের
ভূমি কম,
ঢাকার ঐতিহ্য
সংরক্ষণ—এ
বিষয়গুলো মাথায়
নিয়েই আমরা
পরিকল্পনা করতে
বসি। ঢাকার
মতো বিশেষ
করে ঢাকা
দক্ষিণ সিটি
তথা পুরান
ঢাকার মতো
একটি জনবহুল
এলাকার পরিকল্পনা
মোটেও সহজ
নয়। এ
শহর থেকে
মানুষকে বের
করে দেয়া
যেমন সম্ভব
নয়, আবার
এ শহরে
মানুষের প্রবেশাধিকার
বন্ধ করে
দেয়াও অসম্ভব।
নগরবাসী ও
দেশের মানুষকে
নিয়ে আমাদের
চলতে হবে,
পরিকল্পনা সাজাতে
হবে। এমন
পরিস্থিতিতে অপ্রতুল
নগরীতে আমাদের
বড় স্বস্তি
হয়ে এসেছে
মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের
আগামী দিনগুলো
সোনায় সোহাগা
হোক—এ
আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন