ইস্পাত খাতের বিকাশে জাহাজ ভাঙা শিল্প

১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পটুয়াখালীতে প্রলয়ংকরী সাইক্লোনে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ওই সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় আটকা পড়ে গ্রিক জাহাজ ‘এমভি আলপাইন’। তবে জাহাজটি নিয়ে সে সময় সংকট তৈরি হলে সেখানে দীর্ঘদিন জাহাজটি পড়ে থাকে। পরে চিটাগং স্টিল হাউজ সেই জাহাজটিকে

১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পটুয়াখালীতে প্রলয়ংকরী সাইক্লোনে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ওই সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় আটকা পড়ে গ্রিক জাহাজ এমভি আলপাইন তবে জাহাজটি নিয়ে সে সময় সংকট তৈরি হলে সেখানে দীর্ঘদিন জাহাজটি পড়ে থাকে। পরে চিটাগং স্টিল হাউজ সেই জাহাজটিকে কিনে নিজস্ব উদ্যোগে এবং স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ভেঙে এর যন্ত্রপাতি ধাতব অংশ বাজারে বিক্রি করে। অঞ্চলের জাহাজ ভাঙার কার্যক্রম শুরু মূলত তখন থেকেই।

তবে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ ভাঙার কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা পায় আরো পরে। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জাহাজ আল আব্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাহাজ বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কিনে নেয় কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস। জাহাজ ঘিরেই ফৌজদারহাট এলাকার বিস্তৃত জায়গাজুড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরু হয়। মূলত স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস নিয়মিত দেশী-বিদেশী জাহাজ ভাঙার কাজ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করে।

আশির দশকজুড়ে ধীরগতিতে এগোনোর পর জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিনিয়োগের জোয়ার আসতে শুরু করে মূলত নব্বইয়ের দশকে। জাহাজপ্রতি একটি নির্দিষ্ট মূলধন ব্যয় করে দিগুণ-তিন গুণ লাভের হাতছানি দেখে চট্টগ্রাম ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা ঝুঁকতে শুরু করেন ব্যবসার দিকে। সেই সঙ্গে দেশে ইস্পাতের চাহিদা পূরণে কাঁচামাল জোগানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উৎস হয়ে ওঠে জাহাজ ভাঙা শিল্প।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্রাধিক, স্বভাবতই সেখানে শ্রমিক বেশি, মজুরি কম। সেই সঙ্গে দেশের উন্নয়নকল্পে ক্রমবর্ধমান ইস্পাতের চাহিদা, ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অজ্ঞতা দুর্নীতি সব মিলিয়ে শুরু থেকেই জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকদের জন্য বাধা বলতে কিছুই ছিল না। বরং দেশের অর্থনীতির জন্য সবসময়ই শিল্প আশীর্বাদ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

চট্টগ্রামের উত্তর উপকূলে অবস্থিত দীর্ঘ ১১ কিলোমিটারব্যাপী পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজ ভাঙা শিল্প। পুরনো, বিকল, পরিবহনে অক্ষম, অকেজো, মেরামতের অযোগ্য কার্গো শিপ বা তেলবাহী ট্যাংকারগুলোর শেষ ঠিকানা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। আর পুরো পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ বিকল জাহাজ ভাঙার কাজটি করা হয় বৃহত্তম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে। মূলত আশির দশকে বাংলাদেশে পথচলা শুরু হয় শিল্পের। শ্রমমূল্য কম হওয়ায় এবং দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে লোহার চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে চারাগাছ থেকে মহীরুহে পরিণত হয় শিল্প।

তথ্যমতে, বাংলাদেশের শিল্প-কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় লোহার ৮০-৯০ শতাংশই আসে ফৌজদারহাট সীতাকুণ্ডে অবস্থিত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে। সাধারণত একটি জাহাজের ৯৫ শতাংশই মাইল্ড স্টিল দিয়ে তৈরি হয়। শতাংশ স্টেইনলেস স্টিল এবং বাকি শতাংশ থাকে বিভিন্ন ধাতবের মিশ্রণ, যা রড শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের মূল কাঁচামাল। নির্মাণকাজে ব্যবহূত রড উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বড় একটি অংশই আসে শিল্প থেকে।

জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনের নিবন্ধিত ইয়ার্ডের সদস্য সংখ্যা ১৫১, যার মধ্যে মূল কোম্পানির সংখ্যা ৬০। জুলাই ২০২১-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড চালু আছে ৩০-৩৫টি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০১-০২ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত গত ২০ বছরে চট্টগ্রামের শিপ ইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে হাজার ৩২৯টি। আমদানি করা জাহাজগুলো থেকে এখন পর্যন্ত মোট কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭ টন স্ক্র্যাপ বাংলাদেশে কাটা হয়েছে।

ইয়ার্ডগুলো এতটাই সংরক্ষিত যে সেখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মীরা প্রবেশের অনুমতি পান না। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের এখানে ঢুকতে বিভিন্ন পক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রবেশ করতে হয়। চট্টগ্রামের এসব শিপ ইয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করছে প্রায় ৩০টি শিল্পপতি পরিবার। শিপ ইয়ার্ডের শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশ সরকার স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ঘোষণা করেছে। তবে নানা জটিলতায় বেতন কাঠামো আজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে এখানকার সস্তায় শ্রমিকলভ্যতা শিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প আন্তর্জাতিক রিসাইকেল বাজার ধরেছে প্রায় ৪৭ দশমিক শতাংশ মহাসমুদ্রগামী জাহাজ স্ক্র্যাপের মাধ্যমে। স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে লোহা ছাড়াও অনেক সামগ্রী বিক্রি করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে রফতানি করা হয়। বাকিগুলো দেশের বাজারে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করা হয়। শ্রমিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হওয়ায় অনেক দেশ শিল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে। তাইওয়ান, চীন, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, ক্রোয়েশিয়াসহ প্রভৃতি দেশ এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এরই মধ্যে শিল্প থেকে সরে গেছে। ২০০৮ সাল নাগাদ এসব দেশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো উপকূলবর্তী স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে উৎপাদন বেড়েছে। একটা ছোট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৭৭ সালে তাইওয়ানে শিল্প থেকে উৎপাদিত ধাতুর পরিমাণ ছিল হাজার ৩৯১ টন, স্পেনের ৮৭৩ ইতালির ২৯৯ টন। ২০০৮ সাল নাগাদ তাইওয়ান ইতালি শিল্প বন্ধ করে দিয়েছে আর স্পেনে তা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ছয় টনে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের দিকে শুরু হওয়া শিল্পে বিদেশের বিভিন্ন দেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ২৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৯ টন। পাকিস্তান ভারতেও শিল্পে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বেড়েছে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেন ১৯৯৫ সালের পরে বিভিন্ন সময়ে। বিনিয়োগের কারণে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-মিরসরাই জোনে গড়ে ওঠে একে একে ১৬০টির বেশি শিপ ইয়ার্ড। তবে ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে ব্যবসা বুঝতে না পারা, ব্যাংকঋণের সুদ বেড়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় শিপ ইয়ার্ডগুলো বন্ধ হতে শুরু করে। বর্তমানে শিল্প জোনে চালু আছে ৩০-৩৫টি শিপ ইয়ার্ড। কিছু শিপ ইয়ার্ড চলছে সাব-কন্ট্রাক্টে। বর্তমানে চট্টগ্রামে যারা ঋণখেলাপি কিংবা ব্যাংকের দেনায় জর্জরিত তারা বেশির ভাগই শিপ ইয়ার্ড ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তবে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনায় শিপ ইয়ার্ডগুলোকে আরো আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতে, শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে সব শিপ ইয়ার্ডকে গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে রূপান্তরের নির্দেশনা দিয়েছে। বর্তমানে পিএচপি গ্রুপের শিপইয়ার্ড দেশের ইতিহাসে প্রথম নিজেদের গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে রূপান্তর করেছে। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি শিপ ইয়ার্ড গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে নিজেদের রূপান্তর করার কাজ করছে। তবে যারা এখনো গ্রিন শিপ ইয়ার্ডেও কাজ শুরু করেননি তারা দ্রুতই কাজ শুরু করবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিপ ইয়ার্ড খাতে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশ। বর্তমানে খাতে যে প্রতিযোগিতা চলছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে দেশের সনাতন পদ্ধতিতে চলা শিপ ইয়ার্ডের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পরিবেশবাদীরা নানা সময়ে সমালোচনা করে আসছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি সাধারণ শিপ ইয়ার্ডকে গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে রূপান্তর করতে অন্তত ২৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইয়ার্ড মালিকদের পক্ষে এত ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব না, যার কারণে সরকারকে খাত টিকিয়ে রাখতে হলে বড় অংকের প্রণোদনা না দিলে ইয়ার্ডগুলোয় পরিবেশসম্পন্ন পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের গ্রিন শিপ ইয়ার্ড নিয়ে প্রশ্ন এলে খাতের অবস্থান নিয়ে বড় সংশয়ে পড়বে বাংলাদেশ। সেজন্য ব্যাংকঋণ এবং সরকারের প্রণোদনার সমন্বয় চান ব্যবসায়ী এবং খাতসংশ্লিষ্টরা।

দেবব্রত রায়: সাংবাদিক

আরও