চিটাগং স্টিল মিলস: যার হাতে ইস্পাত শিল্পের যাত্রা

দেশভাগের পর পাকিস্তান ভারী শিল্পে দেশকে এগিয়ে নিতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। ভারতে ওই সময় টাটাসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ ইস্পাত শিল্পে এগিয়ে ছিল। পূর্ব পাকিস্তান আমলেই ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা অঞ্চলে একটি পরিপূর্ণ ইস্পাত কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয় তত্কালীন পাকিস্তান সরকার। ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট

দেশভাগের পর পাকিস্তান ভারী শিল্পে দেশকে এগিয়ে নিতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। ভারতে ওই সময় টাটাসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ ইস্পাত শিল্পে এগিয়ে ছিল। পূর্ব পাকিস্তান আমলেই ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা অঞ্চলে একটি পরিপূর্ণ ইস্পাত কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয় তত্কালীন পাকিস্তান সরকার। ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (ইপিআইডিসি) অধীনে ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গা কর্ণফুলী নদী সমুদ্রবেষ্টিত এলাকায় স্টিল কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১৯৬৭ সালের ২৪ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যাওয়া চিটাগং স্টিল মিলস দেশের ইস্পাত খাত বিকাশের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে পরবর্তীকালে। দেশের ইস্পাত খাতের প্রায় সব উদ্যোক্তাই কাঁচামাল কিংবা বিভিন্ন ফিনিশড পণ্য সংগ্রহ করেন চিটাগং স্টিল মিলস থেকে। প্রায় ৩২ বছর পর ১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেলেও চিটাগং স্টিল মিলস অভিজ্ঞতা সাফল্য দেশের বেসরকারি খাতের ইস্পাত পণ্য খাতে বেসরকারি উদ্যোগও সাফল্যের ডালপালা মেলে ধরে। পাকিস্তান আমলে বাঙালি গোলাম মর্তুজা ছিলেন ইপিআইডিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রংপুরের বাসিন্দা ইপিআইডিসির আরেক ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী হাবিবুল হক খানসহ গোলাম মর্তুজা ১৯৫৯ সালে জার্মানির হ্যান্স মেইডেনকে সঙ্গে নিয়ে পতেঙ্গা এলাকায় আসেন সাইট ভিজিট করতে। তত্কালীন সময়ে চট্টগ্রামের আরেক শিল্পপতি কে খানসহ উত্তর পতেঙ্গার প্রায় ২২৭ একর জমি কারখানা স্থাপনের জন্য নির্ধারণ করেন। পরে ১৯৬০ সালে জমির ২২২ দশমিক ২৪ একর (মসজিদ, কবরস্থান শ্মশানের জন্য কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি) সরকার অধিগ্রহণ করে স্টিল মিলস নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করে। নির্মাণ উৎপাদনকালে চিটাগং স্টিল মিলসের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন জার্মানির হ্যান্স মেইডেন। প্রাথমিক কার্যক্রম শুরুর পর ভারতের প্রখ্যাত টাটা স্টিলের কিছু দক্ষ কর্মী প্রকৌশলী চিটাগং স্টিল মিলসের জন্য নিয়ে আসা হয়। স্টিল মিলস স্থাপনের সমীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক কাজে নিয়োজিত ছিল জাপানি প্রতিষ্ঠান। এখানেই শুরুতেই স্থানীয় কিছু উদ্যোগী তরুণকে নিয়োগ দেয় সরকার। এর অন্যতম স্থানীয় বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে এইচএসসিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৬০ সালে করণিক হিসেবে স্টিল মিলসে নিয়োগ পান তিনি।

সেই থেকে ১৯৯৪ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে অবসরে যাওয়ার আগে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্টিল মিলসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মো. নুরুল ইসলাম সম্প্রতি বণিক বার্তাকে বলেন, পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল ভারতের মতো পাকিস্তানও ইস্পাত ভারী শিল্পে উন্নতি করুক। যার কারণে স্টিল মিলসসহ পাকিস্তানে একাধিক ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করেছিল। ভারী শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকেই প্রাধান্য দিয়েছিল তত্কালীন সরকার। মূলত বন্দর রেল ব্যবস্থাপনাসমৃদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাটকল, কাগজকল, ইস্পাত কারখানা, টেক্সটাইল কারখানা, ট্রান্সমিটার কারখানা, ওয়্যার কারখানা, জাহাজ মেরামত কারখানা, মেশিন টুলস কারখানা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নির্মাণ কারখানা, গাড়ি সংযোজন কারখানাসহ একাধিক ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। তত্কালীন সময়ে চিটাগং স্টিল মিলসে কর্মরত ছিলেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬৭ সালে উৎপাদন শুরুর পর তত্কালীন সরকার এটিকে পাকিস্তানের স্বাবলম্বী অর্থনৈতিক বিকাশের অন্যতম খাত হিসেবে বিবেচনা করে। আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস নামের পরিকল্পনায় চিটাগং স্টিল মিলস প্রতিষ্ঠার পর তত্কালীন পাকিস্তান সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন ১৯৬৯ সালে ১৫ পয়সার একটি স্মারক ডাক টিকিটও প্রকাশ করে। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৃহদাকার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি বাস্তবায়ন করা হয়। শুরুতে দেড় লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ক্রমান্বয়ে এটিকে বার্ষিক আড়াই লাখ টন ইস্পাত পণ্য উৎপাদনের কারখানায় রূপান্তরে উদ্যোগী ছিল পাকিস্তান সরকার। যদিও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। কারখানাটি স্থাপনের ফলে পাকিস্তান সরকার বার্ষিক দশমিক কোটি রুপি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে চিটাগং স্টিল মিলসকে ঘিরে পাকিস্তান সরকারের তৃতীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আরেকটি প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে বার্ষিক পাঁচ লাখ টন ইনগট স্টিল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম চলমান ছিল। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার ভারত ছাড়াও বৈশ্বিক বাজার থেকে ইস্পাত পণ্যনির্ভরতা কমাতে চেয়েছিল। বহুমুখী উৎপাদনের মাধ্যমে অন্যান্য শিল্পের সহযোগী হিসেবে চিটাগং স্টিল মিলস অঞ্চলের শিল্প বিকাশে অনন্য ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। চিটাগং স্টিল মিলসের বিষয়ে মো. নুরুল ইসলাম আরো জানান, চিটাগং স্টিল মিলস তত্কালীন এমনকি বর্তমান সময়ের বিচারেও একটি বৃহদাকার স্বনামধন্য পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত কারখানা ছিল। বর্তমান সময়ের চট্টগ্রামসহ দেশের ইস্পাত খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই চিটাগং স্টিল মিলস থেকে বিলেট, স্টিল শিটসহ বিভিন্ন ইস্পাত পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করে ব্যবসা করতেন। সে সময় চিটাগং স্টিল মিলসের সঙ্গে ব্যবসা করা বেসরকারি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের প্রথম সারির শিল্প-কারখানার মালিক হয়েছেন। জাপান জার্মানির প্রযুক্তিতে যেকোনো ধরনের ইস্পাতপণ্য, ভারী যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য বিখ্যাত চিটাগং স্টিল মিলসের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এখনো স্থাপন না হলেও আগের সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ইস্পাত খাতের বিকাশে দীর্ঘদিন ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি। -সংক্রান্ত একাধিক নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা গেছে, কারখানাটি স্থাপনের প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল তত্কালীন ৫৬ দশমিক ৭০ কোটি রুপি। প্রকল্প ব্যয়ের ১৬ দশমিক ৬৭ কোটি রুপি বৈদেশিক সহায়তা। কারখানাটি স্থাপনের দায়িত্বে ছিল তত্কালীন ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামের সরকারি সংস্থা। জাপানের কোবে স্টিল লিমিটেডর মাধ্যমে ১৯৬৭ সাল নাগাদ কারখানাটির স্থাপনকাজ সম্পন্ন হয়। কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ১৯৬৭ সালের আগস্টে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে চিটাগং স্টিল মিলসকে পৃথক একটি লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়।

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ইস্পাত করপোরেশনের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যাওয়া হয়। কর্ণফুলী নদীতীরে কারখানাটির অবস্থান হওয়ায় ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এর অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয় চিটাগং স্টিল মিলসকে। যার পরিণতিতে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর (স্থায়ী, অস্থায়ী বদলি) বৃহৎ শিল্প কারখানাটি ধীরে ধীরে বন্ধের দিকে নিয়ে যায় সরকার। ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে কারখানাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। চিটাগং স্টিল মিলসের জমিতেই পরবর্তী সমেয় সরকার কর্ণফুলী রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপন করে। ইস্পাত কারখানাটির উৎপাদনক্ষমতা ছিল প্রায় দেড় লাখ টন। চিটাগং স্টিল মিলসের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল স্টিল ইনগট, বিলেট, বুম, রিইনফোর্সড বার, স্ট্রাকচারাল সেকশন, করোগেটেড আয়রন শিট ইত্যাদি। ১৪টি ইউনিটের কারখানায় কাস্টিং ফোরজিং ইউনিট ছিল। বিশেষায়িত ইউনিটে যেকোনো ধরনের ডাইস দিয়ে ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে বৃহদাকার যন্ত্রাংশ, ইস্পাত কাঠামো তৈরি করা হতো। জাহাজ নির্মাণের হেভি প্লেট দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র চিটাগং স্টিল মিলসে উত্পন্ন হতো। যার কারণে জাহাজ নির্মাণ মেরামত শিল্প জনপ্রিয় হয়েছিল চট্টগ্রামে।

১৯৬৭ সালে কার্যক্রম শুরুর বছরে চিটাগং স্টিল মিলস উৎপাদন করেছিল ৬৮ হাজার টন ইস্পাতপণ্য। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের তত্কালীন চাহিদার বিচারে উৎপাদন ছিল যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে চাহিদা বাড়তে থাকলে উৎপাদনও বাড়ানো হয় ক্রমান্বয়ে। দেড় লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার কারখানাটি ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ লাখ ৩৫ হাজার টন পণ্য উৎপাদন করেছিল। যদিও পরবর্তী বছরগুলোতে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চিটাগং স্টিল মিলস বন্ধ হয়েছে প্রায় দুই যুগ। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইস্পাত কারখানা হিসেবে এখনো উদ্যোক্তাদের পথ দেখায় রাষ্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্পটি। স্টিল মিলসে বেড়ে ওঠা শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তাদের পরিবার, পরিবারের সদস্যরা এখনো গর্ববোধ করেন চিটাগং স্টিল মিলস নিয়ে। দেশের ইস্পাত খাতের প্রথম মৌলিক শিল্প কারখানা হিসেবে চিটাগং স্টিল মিলসের দেখানো পথে এখনো হেঁটে চলেছেন সারা দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা চট্টগ্রাম।

সুজিত সাহা: সাংবাদিক

আরও