পাহাড়ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম সান মিলান দে লা কোগোলা।
স্পেনের উত্তরে লা রিওজা অঞ্চলে অবস্থিত এ গ্রামেই রয়েছে বিখ্যাত সান মিলান দে সুসো মঠ।
সন্ন্যাসী সেন্ট মিলান ষষ্ঠ শতকে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এ
মঠেই জন্ম হয়েছিল ৪৮ কোটি মানুষের মুখের ভাষা স্প্যানিশের, যা এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা।
এখানে আছে অনেক গুহা, মঠটি প্রতিষ্ঠার আগে সেগুলোতে সন্ন্যাসীরা বসবাস ও প্রার্থনা করতেন।
এক হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এ সুসো মঠে ভিক্ষুরা ধর্মোপদেশ ও প্রার্থনার কিছু ল্যাটিন গ্রন্থ স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ ও নোট তৈরি করেন।
স্থানীয় এ ভাষাটি ছিল ইবেরো-রোম্যান্স এবং এটিকে বিবেচনা করা হয় স্প্যানিশ ভাষার আদি রূপ হিসেবে।
স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারি ভাষা হিসেবে পৃথিবীর ২০টি দেশ এবং ৪৮ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।
চাইনিজ মান্দারিনের পর এ স্প্যানিশই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মাতৃভাষা।
রাজধানী মাদ্রিদের উপকণ্ঠের আলকালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক জেরো হাভিয়ার গার্সিয়া সানচেজ ব্যাখ্যা করেন, স্প্যানিশ ভাষার উদ্ভব লাতিনের গেঁয়ো রূপ থেকে।
এ
গেঁয়ো ল্যাটিন হলো ভাষার লিখিত, সাহিত্যিক ও ক্লাসিক্যালের সাধারণ চলিত রূপ।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় রোমানদের মাধ্যমে ল্যাটিন ভাষা ইউরোপের ইবেরিয়ান উপদ্বীপে এসেছিল।
সে
সময় ইবেরিয়ান উপদ্বীপের মানুষ উন্নত রোম্যান্স ভাষায় কথা বলত।
বিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় অধিবাসীরা ল্যাটিন গ্রহণ শুরু করে এবং এটি তাদের স্থানীয় ভাষা, শব্দতত্ত্ব, কথা ও অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।
অধ্যাপক গার্সিয়া সানচেজের মতে, লাতিনের মৃত্যু এবং স্প্যানিশের জন্মের নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ নেই।
তবে ইবেরিয়ান উপদ্বীপকে স্প্যানিশের প্রাচীনতম রূপ লিখিত ক্যাস্টেলানো বা ক্যাস্টিলিয়ানের জন্মস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
স্প্যানিশ ভাষা গবেষণা ও শিক্ষার জন্য লারিওজা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের ৪০ বছর পার করেছেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব ইনভেস্টিগেশন অব দ্য স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগের পরিচালক ক্লাউডিও গার্সিয়া তুর্জা।
তিনি বলেন, সেকালে ধর্মোপদেশ ও প্রার্থনার সব বই ল্যাটিন ভাষায় লেখা হওয়ায় সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না।
সহকর্মী সন্ন্যাসীরা সবাই যেন বুঝতে পারে সেজন্য দশ শতকের মঠের একজন সন্ন্যাসী এমন কিছু বই স্থানীয় ইবেরো-রোম্যান্স দ্বিভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
তিনি মার্জিনে মূল গ্রন্থের নোট রেখেছিলেন।
সে
অনুবাদ নোটগুলো বিখ্যাত লাস গ্লোসাস এমিলিয়েন্সেস বা এমিলিয়ান গ্রোসেসে সংকলিত হয়েছে।
সে
পৃষ্ঠাগুলো স্প্যানিশ ভাষার প্রথম পদক্ষেপের স্বাক্ষর।
এর
মাধ্যমে কয়েক শতক আগে ভাষাটি কীভাবে ব্যবহার হতো, তার একটা আভাস পাওয়া যায়।
এটাও বোঝা যায় যে, সে সময় বেশির ভাগ মানুষ নিরক্ষর ছিল।
এ
তথ্যের ওপর ভর করে গার্সিয়া তুর্জ অনেক দূর এগিয়েছেন।
স্প্যানিশ ভাষা বিকাশে সুসো মঠের বড় ভূমিকা ছিল।
এ
মঠ
প্রতিষ্ঠার কয়েক শতক পর স্প্যানিশ ভাষার প্রথম কবি হিসেবে স্বীকৃত গনজালো দে বারসিও এ মঠে বাস করতেন।
সেখানে তিনি এমন কিছু কবিতা স্তবক লেখেন, যা আগে কখনো লেখা হয়নি।
কবি তার জীবদ্দশায় দুই হাজারেরও বেশি শব্দ যোগ করে স্প্যানিশ শব্দকোষকে সমৃদ্ধ করেন।
সুসো মঠ এবং একই আদলে তার বোন সান মিলান দে ইউসোর নামে নির্মিত মঠে প্রতি বছর এক লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে।
নয়জন ভিক্ষু আগত পর্যটকদের সামনে ইউসোর স্থাপত্য ঐতিহ্য তুলে ধরেন।
ইউসো মঠের উপরের গ্রন্থাগারে অনেক বড় বড় বইয়ের দেখা মেলে, যার প্রতিটির ওজন ২০-৬০ কেজি পর্যন্ত।
সেখানে আঠারো থেকে উনিশ শতকের ১০ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে।
এর
একটি বইয়ে স্থানীয় নদী ‘রিও
ওজা’র
নাম অনুযায়ী অঞ্চলের নাম রিওজা ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্প্যানিশ ভাষার জন্মের দলিল।
গার্সিয়া সানচেজের সহকর্মী আলকালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেলেন আলমিদা ক্যাবরিজাস জানান, এটা বলা কঠিন যে স্প্যানিশ ভাষার প্রথম লেখা কোনটি।
কারণ এটি বিভিন্ন মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে।
কোনো সন্দেহ নেই যে, সুসো মঠ স্প্যানিশ ভাষার প্রসারে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল।
এজন্য গার্সিয়া তুর্জ মঠটিকে বলছেন, ‘ভাষাবিদ্যার
বাড়ি’।
স্প্যানিশ ভাষার দীর্ঘতম নোটটি গ্লোসা-৮৯ নামে পরিচিত।
ইবেরো-রোম্যান্স ভাষায় প্রথম বিস্তৃত লেখাটি উত্তরাধিকার ল্যাটিন থেকে নেয়া শব্দের মাধ্যমে একত্রিত, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং বার্তা বহন করে।
এটি প্রথম সম্পূর্ণ পাঠ্য, যেখানে ভাষার সব স্তরকে তুলে ধরা হয়েছে, শুধু যে শব্দ তা নয়, ব্যাকরণ ও শব্দবিন্যাসও।
এগুলো বৃহত্তর জটিলতার প্রমাণ বহন করছে।
গার্সিয়া তুর্জের মতে, সুসো মঠের সন্ন্যাসীরা যদি ইবেরো-রোম্যান্স ভাষার শব্দ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করতে প্রথম হন, তবে স্প্যানিশ বর্ণমালা তৈরির জন্যও তারা দায়ী।
এখানে স্প্যানিশ লেখা আবিষ্কার ও স্প্যানিশ বর্ণমালার আবিষ্কারকে উপলব্ধি করা হয়।
বিশ শতকে স্প্যানিশ কবি ও ভাষাবিদ ড্যামাসো এলোনসো গ্লোসা-৮৯-কে ‘স্প্যানিশ
ভাষার প্রথম কান্না’
হিসেবে অভিহিত করেন।
দেশটির ইনস্টিটিউটো সার্ভেন্টেস ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ৭৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলবে।
তাই এটা নিশ্চিত যে, স্প্যানিশ ভাষার বিলুপ্তির চিন্তা এখনো হাজার হাজার মাইল দূরে।
সূত্র: বিবিসি
ভাষান্তর: শিহাবুল ইসলাম