সান্দাকফু পয়েন্ট থেকে বামে দেখা যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট এবং পৃথিবীর চতুর্থ ও পঞ্চম সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া লোতসে ও মাকালু।
আবার একই জায়গা থেকে হিমালয় রেঞ্জের একটা বিশাল অংশ দেখতে পাওয়া যায়।
হিমালয়প্রেমীদের কাছে তাই সান্দাকফু এক বিশেষ আকর্ষণ।
এবারের ট্রেকিং ছিল সাতদিনের এবং এ ক’দিনে প্রায় ৭০ কিলোমিটার হাঁটতে হবে।
ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে বাগডোগরা বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইটে পৌঁছানো।
একটা দিন শিলিগুড়িতে কাটিয়ে বাগডোগরা থেকে জিপে করে বেজক্যাম্প জউভারির উদ্দেশে রওনা, যেটির উচ্চতা ৬ হাজার ৪০০ ফুট।
আমাদের জিপ চলল মিরিকের রাস্তা ধরে, রাস্তার দুই ধারে চা বাগান আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সমারোহে ভালো লাগার একটা আবহ এমনিতেই তৈরি হতে বাধ্য।
হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে জানাল, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে!
রক্তে চঞ্চলতা জেগে উঠল তখনই, সবাই গাড়ি থেকে নেমে চেষ্টা করলাম সে মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করতে। কিছুক্ষণ সেখানে সময় কাটিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। বেলা ৩টার দিকে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। সন্ধ্যার আগে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলে শরীর উষ্ণের চেষ্টা করা হলো। পাহাড়ের ছেলেগুলো অসাধারণ ফুটবল খেলে! সবাই পৌঁছে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় হেলথ চেকআপ, ব্রিফিং এবং রাতের খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ পরিষ্কার আকাশে অজস্র তারা দেখে বিশ্রাম নিতে চলে গেলাম। পরের দিন ভোরে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম টুমলিংয়ের উদ্দেশে, যার উচ্চতা ৯ হাজার ৪৫০ ফুট। এদিন নয় কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। শুরুতেই একটা ঘন অন্ধকার পাইন বনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে চড়তে হলো। পুরো সান্দাকফু ট্রেকে আমরা কখনো ভারতে, আবার কখনো নেপালে থেকেছি, কারণ পুরো পথটাই ভারত-নেপাল সীমানা ধরে এগিয়েছে। পাশাপাশি ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। অনেকেই তাই মজা করে বলছিল ‘এক টিকিটে দুই সিনেমা, একদিকে সান্দাকফু অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা’।
পাহাড় আর রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে সন্ধ্যার ঠিক আগে আমরা টুমলিং পৌঁছলাম।
ততক্ষণে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করছে, আকাশে ভীষণ মেঘের সঙ্গে তাপমাত্রাও হঠাৎ নেমে গেল।
রাতে একদিকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, অন্যদিকে এত শব্দ করে বাতাস বইছিল যে, মনে হচ্ছিল কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
পরের দিন সকালেও তাপমাত্রা আর বাতাস একই রকম ছিল, আমরা বের হয়ে দেখি কলের পানি পর্যন্ত জমে বরফ হয়ে গেছে।
কিন্তু তার পরও হাঁটতে হবে।
সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে কিছুটা ওয়ার্মআপ করে নিলাম।
দূরে দেখা গেল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় নতুন তুষার জমে আছে।
হাঁটতে শুরু করলাম, গন্তব্য ১২ কিলোমিটার দূরের ‘কালপোখারি’ (১০ হাজার ৪০০ ফুট)। পুরোটা পথ সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
ভাগ্য খুব ভালো থাকলে এখানে দেখা মিলতে পারে রেড পান্ডার (‘কুং
ফু
পান্ডা’ সিনেমার মাস্টার শিফু’র কথা মনে আছে তো?)। কিন্তু সে কপাল সবার হয় না!
সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কের চড়াই-উতরাই পার হয়ে এগোনোর সময় একটা জায়গা থেকে কাঞ্চনঞ্জঙ্ঘা, লোতসে আর মাকালু বেশ পরিষ্কার দেখতে পেলাম, তবে মাউন্ট এভারেস্ট নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল মেঘের আড়ালে।
সারা দিন হেঁটে সন্ধ্যায় পৌঁছলাম কালপোখারিতে, সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে।
সবাই বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম।
সেই রাতটা আমরা একটা টি-হাউজে কাটালাম।
চতুর্থ দিনে লক্ষ্য ১১ হাজার ৯৫০ ফুট উচ্চতার সান্দাকফু পৌঁছানো (উচ্চতা)। হাঁটতে হবে ছয় কিলোমিটার, তবে পুরোটাই চড়াই!
সান্দাকফু পৌঁছানোর পর সবার সে কি আনন্দ, সেখানে পৌঁছাতেই চারপাশে শুধু শ্বেতশুভ্র তুষার! ততক্ষণে তাপমাত্রাও শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
কিছুক্ষণ পরই হালকা তুষারপাতও শুরু হলো।
সান্দাকফু থেকে শেষ বিকালের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন নতুন রূপে দেখা দিল।
যদিও এভারেস্ট, লোতসে আর মাকালু যেন পণ করে ছিল এ যাত্রায় আমাদের সঙ্গে লুকোচুরিই খেলবে! আমাদের তখনই মনে পড়ল যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ সময়টাতে সান্দাকফু ও আশপাশে প্রচণ্ড তুষারপাতের সম্ভাবনা আছে।
সে
রাতে আমরা ছিলাম তাঁবুতে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাঁবুতে থাকার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে।
সুবিধা হলো তাঁবু বেশ উষ্ণ থাকে, তবে বাইরে বের হওয়াটা রীতিমতো অমানবিক শাস্তি মনে হয়।
পরদিনের যাত্রাতেই বুঝলাম, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ফলতে শুরু করেছে। আমরা ভেবেছিলাম সান্দাকফু পৌঁছে যাওয়ার পর ট্রেকিং আর অতটা কঠিন হবে না। কিন্তু আসল ট্রেকিং যেন শুরুই হলো এরপর! সান্দাকফু থেকে আমাদের যেতে হবে সবরগ্রামে, ১৪ কিলোমিটার পথ। এদিন পুরোটা পথ ছিল এক ফুট তুষারে ঢাকা। কিছুক্ষণ পথ চলার পরই শুরু হলো প্রচণ্ড তুষারঝড়। পুরোটা পথ চলতে হয়েছে এ তুষারঝড়ের মধ্য দিয়ে। ঝড়ের কারণে কখনো কখনো ১০ হাত দূরের জিনিসও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। সবরগ্রামে আমাদের তাঁবু একটা পাহাড়ের চূড়ায়, সেখানে আমরা পৌঁছলাম সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। বেশ কয়েকজন ট্রেকার সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে রাতে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আমাদের এ বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও তাঁবুতেই রাত কাটাতে হয়েছে। রাতে তাঁবুর অর্ধেকটা পর্যন্ত তুষারে ঢেকে গিয়েছিল! ভোরে কিছুক্ষণের জন্য যেন মিরাকল ঘটে গেল। মাত্র মিনিট বিশেকের জন্য আকাশ পরিষ্কার হয়েছিল আর আমরা ওই সময়ের মধ্যেই দেখতে পেলাম দুর্লভ এক সূর্যোদয়, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন হাতের স্পর্শে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে আর অন্যপাশে আমাদের নিচে যতদূর চোখ যায় তুলার মতো সাদা মেঘে ঢাকা। ক্ষণিকের জন্য মনে হচ্ছিল এ যেন এক স্বর্গলোক!
ষষ্ঠ দিনের যাত্রা হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই, আকাশ পরিষ্কার দেখেই।
প্রথম ২ ঘণ্টা ভালোভাবেই এগোলাম।
এরপর বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা ফালুট না গিয়ে সরাসরি গোর্খে গ্রামে চলে যাব।
প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ, পুরোটাই পাহাড়ি পথে এবার নিচের দিকে নামতে হবে।
প্রথম ২ ঘণ্টা বেশ ভালোভাবে চলার পর শুরু হলো আসল বিপত্তি।
আমরা যে পথে এগোচ্ছিলাম সে পথে থাকা বাঁশবাগানের সব বাঁশ ভারি তুষারপাতের কারণে নুইয়ে পড়েছে।
তার ওপর প্রায় ২ ফুট গভীর তুষার তো আছেই! আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড নেপালি কুকরি দিয়ে বাঁশ কেটে কেটে আমাদের জন্য পথ তৈরি করে দিচ্ছিলেন।
তাপমাত্রা তখনো ঋণাত্মক।
এরই মধ্যে আমাদের ভিজে জুতা পায়ে দাঁড়িয়ে কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কখন বাঁশ কেটে রাস্তা তৈরি হবে।
২
মিনিট হাঁটছি আবার ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
সন্ধ্যার আগে বৃষ্টি আর শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে অবস্থা আরো খারাপ হলো।
শেষে হেডল্যাম্প জ্বেলে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে রাত ৮টায় (অথচ বিকাল ৪টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা) পৌঁছলাম গোর্খে গ্রামে।
সে
এক
ভয়াবহ দিন ছিল সবার জন্যই! তবে ভোরে অসাধারণ সুন্দর গোর্খে গ্রাম দেখার পর সবারই ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল।
ভ্রমণের শেষ দিনে আমাদের হাঁটতে হয়েছে ১৪ কিলোমিটার।
তবে এদিন আবহাওয়া অনুকূলেই ছিল।
পাহাড়ি পথে লোকালয় পার হয়ে বেলা ৩টার দিকে পৌঁছলাম সেপি নামক একটা গ্রামে।
পুরোটা পথে দেখা হয়েছে বেশকিছু পাহাড়ি জনপদ আর তাদের সাধারণ জীবন।
সেপিতে দুপুরের খাবার সেরে সবাই সবার থেকে বিদায় নিলাম।
সেপি থেকে আমরা কিছু মানুষ চলে গেলাম দার্জিলিং শহরে।
দার্জিলিং শহরে একটা দিন থেকে আর কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে আরো কিছু আলাপ সেরে অবশেষে ফিরে এলাম দেশে! এ ট্রেকিংয়ে প্রাপ্তি অনেক, আক্ষেপ কেবল এভারেস্টকে পরিষ্কার দেখতে না পাওয়া।
তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন সে আক্ষেপ বারবার ঘুচিয়ে দিয়েছে নানা রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়ে।
তাই তো সবরগ্রামে কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে সবাই মিলে গাইলাম অঞ্জন দত্তের জনপ্রিয় গান, ‘কাঞ্চন
জানা, কাঞ্চন ঘর; কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাঞ্চন মন; তো পাইলে সোনা, মনু হইয়ো; মউল্লা, হানচু কাঞ্চন’।
আরাফাত রহমান
প্রভাষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়