পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নান্দনিক জায়গা ঘুরে বেড়াতে পর্যটকদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ট্যুর গাইড সার্ভিস। অচেনা জায়গায় ঘুরতে গেলে অনেক সময় পর্যটকরা চিন্তায় পড়ে যান কীভাবে কাঙ্ক্ষিত এলাকায় পৌঁছানো যায়। দুর্গম ও অচেনা পর্যটন স্পটগুলোতে অনেক সময় পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসতে চাইলেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন পর্যটকরা। এর থেকে পরিত্রাণ দিতে সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য তিন জেলা ও এসব জেলার উপজেলাগুলোয় গাইড সেবার সার্ভিস জনপ্রিয় একটি পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
শুরুতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ পেশায় এলেও বর্তমানে গাইড সার্ভিস একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। প্রথমদিকে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তরুণরা এ পেশায় এলেও বর্তমানে স্থানীয় বাঙালি তরুণরাও গাইড পেশায় প্রবেশ করছে। গাইড পেশার পরিধি বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। জেলা প্রশাসন কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় এমনকি পৌর এলাকা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদও এখন ট্যুরিস্ট গাইড ও গাইড সংগঠনকে তদারকির আওতায় নিয়ে এসেছে। দুর্গম এলাকায় বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবং আগের ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গাইডদের তদারকি, নিবন্ধন, গাইড সংগঠনের নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটে। পার্বত্য এলাকার জনপ্রিয় ও সহজতর পর্যটন স্পটগুলোর পরিবর্তে সাম্প্রতিক সময়ে কমিউনিটি ট্যুরিজম ও দুর্গম এলাকায় ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়েছে। তরুণরাই বিভিন্ন অজানা গন্তব্য, সদ্য উন্মোচিত ঝরনা বা পাহাড় ভ্রমণ করতে চায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এসব এলাকায় যেতে স্থানীয় কোনো বাসিন্দার সাহায্য নেয়া ছাড়া উপায় নেই। এ কারণে প্রশাসনও নির্দিষ্ট পর্যটন এলাকায় যেতে গাইড পর্যটকদের গাইড রাখা বাধ্যতামূলক করেছে।
এ পেশা লাভজনক হয়ে ওঠায় স্থানীয় তরুণ এবং বিভিন্ন বয়সী পুরুষ যুক্ত হচ্ছেন ট্যুর গাইড পেশায়। এ অঞ্চলে পেশাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে গাইডদের জন্য তৈরি হয়েছে সংগঠন। এ সংগঠন স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসনের অনুমোদনক্রমে পরিচালিত হয়। এ সংগঠনের মাধ্যমে সব ধরনের ভাড়া, পরির্দশন এলাকা ঘোরানো বাবদ কত টাকা নেয়া হবে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা নিদ্রিষ্ট করে দেয়া থাকে। কোন গাইডকে পর্যটকরা কোন দিকে নিয়ে যেতে চান তার তালিকা অনুযায়ী ভাড়া দিতে হবে। এ তালিকার বাইরে গাইডদের অতিরিক্ত অর্থ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি পর্যটক তাদের ভ্রমণের সময় কোন গাইডকে কতদিন সঙ্গে রাখলে কত টাকা দিতে হবে সব সংগঠনের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পরিশোধ করতে পারবেন।
এদিকে কোনো গাইড যদি দায়িত্বে থাকার সময় পর্যটকদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন কিংবা ভ্রমণকালে অসহযোগিতা করেন তাহলে সংগঠনের দেয়া যোগাযোগ নম্বরে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন পর্যটকরা। সেক্ষেত্রে সেই গাইডের বিষয়ে সার্বিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করে সংগঠনটি। পর্যটকদের গন্তব্যে পৌঁছার পর তথ্য সরবরাহ এবং ফেরার তথ্য প্রশাসনের কাছে সরবরাহ করে গাইডরা।
এদিকে গাইড সার্ভিসটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতিও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। ট্যুর গাইড পেশাটি বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় স্থানীয়দের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ছে স্থানীয়দের। আগে কৃষিকাজসহ অন্যান্য মজুরি পেশায় জড়িয়ে পড়া কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যারা কাজের জন্য চলে গিয়েছিলেন তারাও এখন নিজ এলাকায় গাইড পেশায় ফিরে আসছেন। এতে কাজের সংকট সমস্যা সমাধান অন্যদিকে আর্থসামজিক উন্নয়নের ফলে বাড়িতে থেকেই স্বনির্ভর ট্যুর গাইড পেশায় চলে আসছেন স্থানীয়রা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এ পেশায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ট্যুর গাইডদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জরুরি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বল্প পরিসরে উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে ইংরেজি ভাষা জানা গাইডের স্বল্পতা বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না। এসব গাইডের স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব থাকায় শুধু গন্তব্যে পৌঁছানো ও ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্বই পালন করে গাইডরা। ফলে বিপুল সম্ভাবনা থাকায় ট্যুরিস্ট গাইড পেশাকে আরো বেশি এগিয়ে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।