এক সময় পোর্টো গ্রান্ডে কিংবা ইসলামাবাদ নামেও পরিচিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম। চট্টলা, চাটগাঁ নামে অধিক পরিচিত চট্টগ্রাম বাংলাদেশ তো বটেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিচারে প্রাচ্যের রানী হিসেবেও সুনাম রয়েছে। বন্দর শহর চট্টগ্রাম হাজার বছর আগে থেকেই বিদেশী বণিক, পরিব্রাজক, শাসকদের জন্য ছিল আকর্ষণীয় একটি অঞ্চল। তাই আরব বণিক থেকে শুরু করে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ইরান-ইরাকের বণিকসহ নানা দেশের মানুষ এখানে এসে বসতি গড়েছে, ব্যবসা করেছে, কেউ কেউ শাসনও করেছে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে পাহাড়, নদী ও সাগরের অপূর্ব মেলবন্ধন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শহরটিও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাকেন্দ্রিক জনপ্রিয় প্রাকৃতিক স্থান, সমুদ্র সৈকত, ঝরনা, পাহাড়, ইকোপার্ক, নদী, সুফি সাধকদের মাজার, বৌদ্ধবিহার, মন্দির, প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকার কেন্দ্রে থাকে। চট্টগ্রাম জেলার সদর ছাড়া ১৫টি উপজেলায় নানামুখী পর্যটন রয়েছে। এর মধ্যে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ, উরিরচর চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় পর্যটনের অন্যতম অনুষঙ্গ।
চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরেই রয়েছে ওয়ার সিমেট্রি, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি), পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, বাংলাদেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, ফয়স’ লেক, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, হালিশহর খেঁজুরতলা বিচ, বায়েজিদ বোস্তামির মাজার ও ওখানকার শতবর্ষী কাছিম দর্শন, বার আউলিয়াদের বিভিন্ন মাজার, দেড়শ বছরের পুরনো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার, লালদীঘি মসজিদ, আসকার দিঘী, আগ্রাবাদ ঢেবা, পাহাড়তলি জোড় ঢেবা, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শতবর্ষের পুরনো চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, বলুয়ার দিঘী, দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাটকল আমিন জুট মিলস, জিয়া জাদুঘর, নেভাল একাডেমি পর্যটন স্পট, বাটারফ্লাই পার্ক, অভয়মিত্র ঘাট, শাহ আমানত সেতু, শতবর্ষী পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, কর্ণফুলী নদী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মিঠাপানির কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন নদী হালদা, পরীর পাহাড়, কোর্ট বিল্ডিং, ডিসি অফিস, বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের আবক্ষ মূর্তি, চট্টেশ্বরী মন্দির, বৌদ্ধবিহার, ডিসি হিল, ম্যানোলা পাহাড়, দেব পাহাড়, দেশের প্রধান সামুদ্রিক মত্স্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারি ঘাট, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শতবর্ষী রেলওয়ে সেতু, সমুদ্র ভ্রমণ, রাশমনি ঘাট, পাহাড়বেষ্টিত বায়েজিত লিংক রোড, জাম্বুরি মাঠ, রেলওয়ে যাদুঘর, বিপ্লবী বীরকন্যা প্রীতিলতা স্মৃতি স্থাপনা, বাটালী পাহাড়, পোর্ট ভিউ, বায়েজিদ ইকোপার্ক, জাতিসংঘ পার্ক, বিপ্লব উদ্যান, টাইগার পাস, চিড়িয়াখানা, একাধিক শিশুপার্ক, মিনি বাংলাদেশ, পর্তুগিজ দুর্গ, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিভিন্ন শতবর্ষী স্থাপনাসহ বৈচিত্র্যময় সব পর্যটন স্থাপনা। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম শহরের সমুদ্র ও নদীতীরবর্তী স্থানগুলো দিয়ে নির্মিত মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।
মেট্রোপলিটন শহরের পর্যটনের বিড়ম্বনা হচ্ছে যানজটের কারণে একদিনে একাধিক স্পট পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের পর্যটন স্পটগুলোর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক স্থানে ভ্রমণ করা সম্ভব। যার কারণে কেউ চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ভ্রমণে এলে নগর ভ্রমণকেও তালিকায় রাখে সযতনে। কেউ চট্টগ্রাম শহরের ভ্রমণ শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন উপজেলা, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যায়। আবার অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার ঘুরে এসে ফেরার পথে চট্টগ্রামের এসব পর্যটন স্পট ভ্রমণ করে। চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক এসব পর্যটনের জন্য আগে কোনো ট্যুর প্যাকেজ সুবিধা না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিত্যনতুন প্যাকেজ হাতে নিয়েছে পর্যটকদের জন্য। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি জাহাজযোগে কক্সবাজার ভ্রমণের সুবিধা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোর্য়াটার ছিল চট্টগামে। যার কারণে চট্টগ্রাম শহরের একটি বড় অংশই রেলওয়ের মালিকানাধীন। সিআরবি, আকবর শাহ, পাহাড়তলি, আমবাগানসহ সিটি করপোরেশন এলাকার অন্তত কয়েক হাজার একর জমি এখনো বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রাধীন। ফলে চট্টগ্রামের যেখানেই ভ্রমণ করা হোক রেলওয়ের ব্রিটিশ আমলের নির্মিত বৈচিত্র্যময় স্থাপনা, পাহাড়, সড়ক বিদ্যমান। প্রায় ৩৬৬ একরের কৃত্রিম হ্রদ ‘ফয়স’ লেক’ চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্য্যকে কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। একসময় রেলওয়ে মানেই ছিল বন্দর। ব্রিটিশরা রেলওয়ে ও বন্দরকে একসঙ্গেই বাংলা অঞ্চলের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদন করত। পরবর্তী সময়ে রেলওয়েকে ভেঙে বন্দরকে স্বতন্ত্র করলেও এখনো চট্টগ্রামকে রেলের শহর নামেই চেনে মানুষ।