শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়ানো কোর্সগুলোর একটি হলো প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন নিয়ে ডানপন্থী ও বামপন্থী বন্ধুদের থেকে সাধারণ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাকে। ওয়েস্টার্ন কানসাসে যেসব রিপাবলিকানের সঙ্গে আমি বড় হয়েছি, জনমত জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় ব্যবধানে এগিয়ে না থাকার কারণটি তারা ঠিক ধরে উঠতে পারছেন না। একইভাবে কমলা হ্যারিসেরও জরিপে অনেকখানি এগিয়ে না থাকার কারণ নিয়ে অনুসন্ধানে চালাচ্ছেন আমার চারপাশের ডেমোক্র্যাটরা।
সমসাময়িক মার্কিন রাজনীতিকে বুঝতে হলে সঠিক প্রশ্নটি হলো এ দুজনের কেউই কেন এগিয়ে নেই। সাধারণ দৃষ্টিতে ডেমোক্র্যাটদের ঝাণ্ডাবাহী হিসেবে কমলা হ্যারিসের আকস্মিক উত্থানের মতো গতানুগতিকতার বাইরের ঘটনাগুলোকে বাদ দিলে এবারেরটিও আগের দুই নির্বাচনের মতোই। এমনকি তা আসলে গত ৮০ বছরের নির্বাচনের সাধারণ প্রবণতারই প্রতিফলন। কিন্তু এবারের ইলেকশন ক্যাম্পেইনের দুটি বিষয় ২০২৪ সালের নির্বাচনকে বড় মাত্রায় আলাদা করে তুলেছে। এর মধ্যে প্রথমটি ডেমোক্র্যাটদের উদ্বেগের কারণ। দ্বিতীয়টি রিপাবলিকানদের হতাশার উৎস।
ডেমোক্র্যাটদের দিয়েই শুরু করা যাক। ঐতিহাসিক প্রবণতার সঙ্গে সংগতি রেখেই হোয়াইট হাউজ নিয়ন্ত্রণকারী দলের প্রার্থীকে এখন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এবারের নির্বাচনে যদি কমলা হ্যারিস জয়ী হন তাহলে তিনিই হবেন ৭৬ বছরের মধ্যে প্রথম প্রার্থী যিনি ৫০ শতাংশের কম অ্যাপ্রুভাল রেটিং (প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার জরিপভিত্তিক রেটিং) নিয়ে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।
চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে এ জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন শুধু হ্যারি ট্রুম্যান, ১৯৪৮ সালে। সে সময় তার অ্যাপ্রুভাল রেটিং ছিল ৪০ শতাংশ (যদিও এ জরিপ হয়েছিল ভোটগ্রহণের চার মাস আগে)। এরপর থেকে সাতজন প্রার্থী নিজ দলের অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে। ২০২০ সালে নির্বাচনের দিন তার অ্যাপ্রুভাল রেটিং ছিল ৪৬ শতাংশ। জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অ্যাপ্রুভাল রেটিং ৩৯ শতাংশ, যা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের অ্যাপ্রুভাল রেটিংয়ের তুলনায় ৬ পয়েন্ট কম (৪৫%)।
প্রেসিডেন্টের অ্যাপ্রুভাল রেটিং এবং নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যকার এ সম্পর্ক সনাতনী এ ধারণাকেই সমর্থন করে যে নির্বাচন হলো আদতে ক্ষমতাসীন দলের পারফরম্যান্স নিয়ে গণভোট। বিদেশে (ইউক্রেন ও গাজা) ও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরের (দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অভিবাসী প্রবেশ) যেসব বিষয় বাইডেনের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে সার্বিকভাবে সেগুলোই জনসাধারণের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করছে। নির্বাচনের বছর বাইডেন এমন একটি অর্থনীতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেখানে কিছু সূচকে ভালো হলেও (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অন্যান্য সূচকে (যেমন জনসাধারণের ব্যয়যোগ্য আয়) পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো ছিল না।
ভোটারদের হয়তো দূরদৃষ্টির অভাব থাকতে পারে। আবার তারা হয়তো অর্থনীতির মতো জটিল ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে অতিমূল্যায়নও করতে পারে। খারাপ সময়ের জন্য অতিমাত্রায় দায়ী করা এবং ভালো সময়ের জন্য অতিরিক্ত কৃতিত্ব দেয়ার বিষয়টি ভোটারদের খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা। বিষয়টি যা-ই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা এ ধরনের ধ্যানধারণাকে খুব কমই প্রভাবিত করতে পারেন। এজন্য বলা হয় রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হওয়ার চেয়ে ভাগ্যবান হওয়াই উত্তম।
এ কারণে ২০২৪ সালের নির্বাচনী লড়াইয়ে কমলা হ্যারিস এগিয়ে যেতে পারছেন না। কারণ ক্ষমতাসীন হিসেবে নির্বাচনের মৌলিক বিষয়গুলো ডেমোক্র্যাটদের প্রতিকূলে। প্রতিযোগিতায় কমলা হ্যারিসের এগিয়ে থাকার পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রবণতাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্যাখ্যাযোগ্য।
অন্যদিকে ট্রাম্প অভূতপূর্বভাবে নিজেকে গোটা নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পেরেছেন। বিষয়টি অনেক ভোটারকে উজ্জীবিত করেছে। আবার অন্যদের আতঙ্কিতও করেছে। ট্রাম্পকে বাদ দিলে ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন ছিলেন সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। উপরন্তু ট্রাম্পকে প্রতিরোধের বিষয়টি ধারাবাহিকভাবেই জোরালো হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকেই দেখা যাচ্ছে তার জনপ্রিয়তার চেয়ে অজনপ্রিয়তার রেটিং বেশি।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের অজনপ্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রে তিনিই একমাত্র প্রধান নির্বাহী, যার ক্ষমতায় থাকাকালে অ্যাপ্রুভাল রেটিং কখনই ৫০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তার গড় অ্যাপ্রুভাল রেটিং ৪১ শতাংশ ইতিহাসের সর্বনিম্ন, যা জিমি কার্টারের চেয়ে ৪ পয়েন্ট কম।
তবে ইতিহাসে আর কোনো প্রার্থীই তার মতো নিজেকে এভাবে সবকিছুর কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেননি। এমনকি আকর্ষণীয় ধরনের জনপ্রিয়তার জন্য খ্যাত রোনাল্ড রিগ্যানও নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে নির্বাচনী আলোচনায় ট্রাম্পের মতো প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেননি। রিগ্যান তার দলের জন্য খুবই অনুকূল পরিস্থিতিতে ১৯৮০ ও ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। এমনকি তার ক্যারিশমাকেও নির্বাচনে সাফল্যের কারণ নয় বরং সাফল্যের ফল বলা যেতে পারে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল তার নিজের দলেই। ২০১৬ সালে মনোনয়ন নিশ্চিতের আগ পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির কর্তারা তাকে সমর্থন দেয়ার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আবার রিপাবলিকানপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলোও হয় তার প্রতিপক্ষকে সমর্থন দিয়েছে আর নয়তো কাউকে দেয়নি। তার জনতোষণবাদ, উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা, দীর্ঘদিনের রিপাবলিকান নীতির প্রতি অবজ্ঞা এবং ব্যক্তিগত ত্রুটি ও আচরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন দলের নেতাদের অধিকাংশই। অনেকেই পরে তাকে সমর্থন দিয়েছেন ঠিকই। আবার অনেকেই আছেন, যারা তাকে কখনই মেনে নিতে পারেননি।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন অভিজ্ঞতাও অনেককে তার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। অনেক রিপাবলিকানের চোখে (এবং স্বতন্ত্রদেরও) প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন এবং বিদেশী মিত্র ও বৈরী দেশগুলোর সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে দল ও দেশের আগে স্থান দেন। তার ইভানজেলিকদের মন জেতার প্রয়াস, একলা চলার নীতি এবং বর্ণবাদী হোয়াইট ন্যাশনালিস্টদের প্রতি প্রশ্রয়মূলক আচরণেও অনেকে ক্ষুব্ধ। অনেকেই এখনো ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিনতাইয়ের চেষ্টা ও ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ইউএস ক্যাপিটালে হামলার ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। অধিকাংশ ডেমোক্র্যাট ও নিরপেক্ষ ভোটার শুরু থেকেই তার বিরোধিতা করে এসেছেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পেরও এগিয়ে না থাকার এগুলোই কারণ। এমন সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাওয়া কঠিন যে স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাভাবিক কোনো প্রার্থী হলে রিপাবলিকানরাই এবার ফেভারিট হতো। কিন্তু ২০২৪ কোনো স্বাভাবিক বছর না। কারণ ট্রাম্পও কোনো স্বাভাবিক প্রার্থী না।
নির্বাচনে ফলাফলের কাঠামো গড়ে দিচ্ছে মার্কিন ভোটারদের দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে উদ্বেগ। এ উদ্বেগ ও প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব—উভয়েই এখন তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি (প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব) আগে কখনই এ সিদ্ধান্তে এতটা প্রভাবক হয়ে উঠতে পারেনি। লাখ লাখ—সম্ভবত কয়েক মিলিয়ন—ভোটার এখন তাদের দলের প্রতি আনুগত্য, নীতিগত অগ্রাধিকার এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে বিবেচনার বাইরে রাখছেন, যাতে এমন কোনো প্রার্থী জয়লাভ না করেন যাকে তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং নির্বাচনে জয়লাভের অযোগ্য ভাবছেন। এ নির্বাচনে কে জয়ী হবে, স্বাভাবিক রাজনীতি না অস্বাভাবিক রাজনীতি; সেটি আমরা খুব শিগগির জানতে পারব।
[লেখক ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোয় পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক। সাবেক দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও জেরাল্ড ফোর্ডের যৌথ নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন ও দ্বিদলীয় ন্যাশনাল কমিশন অন ফেডারেল ইলেকশন রিফর্মের রিসার্চ টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক ছিলেন।]