সংস্কারের মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠন ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল রাজধানীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠককালে প্রধান উপদেষ্টা এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্তমান সময়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত।’ ছাত্র-জনতার বিপ্লব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি বাংলাদেশে নতুন আশাজাগানিয়া যুগের সূচনা করেছে।’
প্রধান উপদেষ্টা মার্কিন প্রতিনিধি দলের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভোট কারচুপি প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং বিচার বিভাগ, পুলিশ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। স্বৈরাচার সরকারের ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের দ্বারা আত্মসাৎকৃত ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্নীতির মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা দুর্নীতির এক গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দল অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তারা বলেন, ওয়াশিংটন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারলে আনন্দিত হবে।
বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, ড. ইউনূস সরকারের বাস্তবায়নাধীন সংস্কার কর্মসূচিতে তারা প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী। বৈঠকে আর্থিক খাতের সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রম পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়েও।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত ড. লুৎফে সিদ্দিকী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (সিনিয়র সচিব) লামিয়া মোরশেদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার আগে গতকাল সকালে সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গেও বৈঠক করে সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দল। সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সৌজন্য সাক্ষাৎ হয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। এরপর বৈঠক হয় অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। এরপর বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ২০ কোটি ডলারের সহায়তার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হয়।
এসব বৈঠকের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, ‘প্রথম আশ্বাস, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করতে চান, সেটার প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই তারা প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা আর্থিক সংস্কারের জন্য যেসব খাত চিহ্নিত করেছি, সেগুলোয় তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।’
পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা ব্রডলি আর্থিক খাতের সংস্কারের ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছি। অর্থ পাচারসংক্রান্ত বিষয় নিয়েও কথাবার্তা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে এক্সপার্টিজ আছে, সেটা হয়তো আমরা ব্যবহার করব; আলোচনা কেবল শুরু হয়েছে, চূড়ান্ত হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।’
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সফরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কিনা, তা পররাষ্ট্র সচিবের কাছে জানতে চান এক সাংবাদিক। জবাবে তিনি বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যান, সাধারণত তিনি কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন না, এখন পর্যন্ত সেটা আমরা জানি। সেক্ষেত্রে, আমি যতটুকু জানি, রিসেপশন ধরনের হয়ে থাকে। যদি দুপক্ষের শিডিউল মেলে তাহলে হয়তো সেখানে দেখা হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।’
শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘শ্রম আইন নিয়ে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, সেসব তাদের বলেছি। এসব পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা নোট নিয়েছে। এগুলোকে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।’
র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘সাধারণভাবে আমরা র্যাবের সংস্কার নিয়ে যেসব কাজকর্ম করছি, সেগুলো তুলে ধরেছি। এ আলোচনা চলমান থাকবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের জিএসপি সুবিধা নিয়ে আলোচনার কথা জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘এ নিয়ে সাধারণ একটা আলোচনা হয়েছে এবং এটার যে প্রক্রিয়া, সে প্রক্রিয়া সম্পর্কে কথা হয়েছে।’
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক ফেসবুক পোস্টে বলেছে, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠান গঠন ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে আমাদের প্রতিনিধি দল। যেহেতু বাংলাদেশ আরো ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র সে প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে প্রস্তুত।’
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে দূতাবাস বলেছে, ‘বাংলাদেশের নব উদ্যমে প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়াকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করব। এ লক্ষ্যে শীর্ষ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনায় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও টেকসই উন্নয়নকে ঘিরে তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে আমাদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়েও একটি পোস্ট দিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। তাতে বলা হয়েছে, ‘আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’