টাকার অবমূল্যায়নে বিদ্যুতের বিল পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে বিপিডিবির

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে বিদ্যুতের বিল বাবদ ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে যাচ্ছে খাতটিতে সরকারের দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ। বিষয়টি স্বীকার করছেন বিপিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্টরাও। বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতা সংস্থাটির এক হিসাবে বলা হয়েছে, ডলারের বিনিময় হার প্রতি ১ টাকা বৃদ্ধির জন্য চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাতটিতে ভর্তুকির

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে বিদ্যুতের বিল বাবদ ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে যাচ্ছে খাতটিতে সরকারের দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ। বিষয়টি স্বীকার করছেন বিপিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্টরাও। বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতা সংস্থাটির এক হিসাবে বলা হয়েছে, ডলারের বিনিময় হার প্রতি ১ টাকা বৃদ্ধির জন্য চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাতটিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে ৪৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী গত ও চলতি অর্থবছরের ডলারের গড় বিনিময় হারের পার্থক্য হিসাব করে দেখা গেছে, এবার বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়াতে হবে অন্তত সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। 

একক ক্রেতা হিসেবে বিপিডিবি সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেনে বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (আইপিপি, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ইত্যাদি) এবং আমদানীকৃত বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ক্রয় চুক্তিতে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয় ডলারে। এতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতিও বিপিডিবিকে বহন করতে হয়। 

সংস্থাটির নিজস্ব এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে প্রতি ১ টাকা অবমূল্যায়নে খাতটিতে ব্যয় বেড়ে অতিরিক্ত ভর্তুকির প্রয়োজন বাড়বে ৪৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল প্রায় ১১০ টাকা। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঘোষণায় ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে মুদ্রাটির মধ্যবর্তী বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকায়। এ দর অর্থবছরের বাকি দুই মাস স্থিতিশীল থাকলে চলতি অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় হার দাঁড়াবে প্রায় ১১১ টাকা ১৩ পয়সায়। গত অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল প্রায় ৯৯ টাকা ৪৫ পয়সা। সেক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় হারে পার্থক্য দাঁড়ায় ১১ টাকা ৬৮ পয়সায়। এ পার্থক্যকে বিবেচনায় নিলে সরকারকে চলতি অর্থবছরে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে আরো ৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকারও বেশি। 

তবে বাজারে কোথাও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সরকারের টাকার অবমূল্যায়নজনিত ভর্তুকি বাবদ ব্যয় আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করছেন বিপিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ট্যারিফ চুক্তি করা হয় ডলারে। ফলে ডলারের নির্ধারিত নতুন দরেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ডলারের বিনিময় হারের এ পরিবর্তনে বিপিডিবির ব্যয়ের বোঝা আরো বাড়ল।’

বিপিডিবি সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেনে আইপিপিগুলোর কাছ থেকে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু আইপিপিগুলোর কাছ থেকেই বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে মোট ৫৯ হাজার ২২ কোটি টাকার। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল ৯ হাজার ২২৩ কোটি টাকার বিদ্যুৎ। আর ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে কেনা হয়েছে ৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকার বিদ্যুৎ। একই সঙ্গে বিপিডিবি যেসব বিদেশী কোম্পানি সঙ্গে যৌথভাবে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে সেগুলোরও বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণ হচ্ছে ডলারে। 

আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিপিডিবির নেয়া বিদেশী ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়ও বাড়বে বলে আশঙ্কা বিপিডিবি কর্মকর্তাদের। ২০২৩ সালের জুন শেষে বিপিডিবির দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা।

বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, শুধু টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে গত তিন অর্থবছরে সংস্থাটির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মোট ২ হাজার ১৬৩ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮১ পয়সা। ওই অর্থবছরে বিপিডিবির বিনিময়জনিত লোকসান ছিল মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় হার ৮৬ টাকা ৩০ পয়সায় উঠে গেলে সেবার বিপিডিবির বিনিময় হারজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক লাফে ৬১২ কোটি টাকায় উঠে যায়। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় হার গিয়ে দাঁড়ায় ৯৯ টাকা ৪৫ পয়সায়। সেবার সংস্থাটির শুধু বিনিময় হারজনিত ক্ষতি হয় ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার বেশি। 

২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনা বাবদ ব্যয় ছিল মোট ৯৮ হাজার ৬৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ সংস্থাটির আয় ছিল ৫০ হাজার ৮৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ কেনা ও বিক্রি বাবদ সংস্থাটির অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে বিপিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি পাওয়ার পরও রাজস্ব আয়-ব্যয়ে সংস্থাটির মোট লোকসান ছিল ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। 

ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে এ পরিকল্পনার কতটুকু কাজে দেবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আর্থিক লোকসান থেকে বিপিডিবিকে বের করে আনতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এরই একটি উদ্যোগ ভর্তুকি কমিয়ে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের দাম স্বল্প পরিসরে সমন্বয় করা। এতে বিপিডিবির লোকসান ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে। তবে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপিডিবির ওপর এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। তবে সেটিও কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বিপিডিবি।’

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের জন্য ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৯ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। প্রতি বছর বিপিডিবির ক্রয়কৃত বিদ্যুতের বেশির ভাগই আসে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং আমদানির মাধ্যমে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ব্যয়ও বিপিডিবিকে বহন করতে হয়। বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বাদে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ব্যয়ও পরিশোধ করতে হয় ডলারে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা মোট ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হাতে মোট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি। এদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনাও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি এসব বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা দাবি করছেন, তাদের ওপরেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। আইপিপিগুলো বিশেষ করে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদন চালু রাখে জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করার ফলে এলসি নিষ্পত্তি করতে গিয়ে নানা ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় হার ৭ টাকা বেড়ে যাওয়ায় ফার্নেস অয়েল আমদানিকারকদের ৪০০-৫০০ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ বর্তমানে ফার্নেস অয়েলের অনেক এলসি নিষ্পত্তি হয়নি। এটি আইপিপিগুলোর জন্য বড় ক্ষতি। এমনকি তা ফার্নেস অয়েল আমদানিকারকদের আর্থিক সক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করছে।’

বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিপিডিবি। দীর্ঘদিন পড়ে থাকা এ বিল সর্বশেষ বিশেষ বন্ডে রূপান্তর করে পরিশোধ করছে সরকার। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো বিদ্যুতের বকেয়া বন্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। নতুন করে টাকার অবমূল্যায়নে বিপিডিবির ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়ল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক রহমত উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ট্যারিফ চুক্তি ডলারে। চুক্তিগুলো সেভাবেই করা, যেখানে সব দায় বিপিডিবির। বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি থেকে সব জিনিস আমদানিনির্ভর। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে। এমনকি সেটা অনেক বেশি পরিমাণে বাড়তে পারে। নতুবা ভর্তুকি কমানো নয়, বরং আরো বাড়াতে হতে পারে। প্রশ্ন হলো বিপিডিবি ভর্তুকি ও ট্যারিফ দুটোই বাড়িয়ে এ চাপ কতদিন সামাল দিতে পারবে?’

দেশের বিদ্যুৎ খাতের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছে এ খাতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার সেল’। সংস্থাটি মনে করছে, বিপিডিবিকে লোকসানের বৃত্ত থেকে টেনে তুলতে হলে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই। ভোক্তার ওপর ব্যাপকভাবে চাপ তৈরি না করে স্বল্প পরিসরে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো যায় সে পথ খোঁজা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে গতকাল তার কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এর আগে তিনি বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘বিপিডিবিকে আর্থিক লোকসান থেকে বের করে আনার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হচ্ছে, তবে সেটি স্বল্প পরিসরে। বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন খরচ ভোক্তাকে দিতে হবে। সরকার আর কত ভর্তুকি দেবে?’ 

আরও