অভিমত

প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা কি শুধু ঘোষণায়ই সার?

আবু তাহের খান

ছবি : বণিক বার্তা

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে সরকার ১৯৯৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৫ বছরে পাঁচ দফায় দেশের মোট ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করেছে। উল্লিখিত ১৩টি এলাকা হচ্ছে সুন্দরবন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, মারজাত বাঁওড়, বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদ, গুলশান-বারিধারা লেক ও জাফলং-ডাউকি নদী। এর বাইরে চলনবিল ও হালতি বিলকেও সম্প্রতি ইসিএ-ভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, কোনো একটি এলাকাকে ইসিএ-ভুক্ত হিসেবে ঘোষণা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে এলাকাকে ঝুঁকিতে থাকা বিপন্ন দশা থেকে রক্ষাকল্পে বিশেষ অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্য ও হতাশার বিষয় এই যে ইসিএ হিসেবে ঘোষণার পরও ওই এলাকাগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পরিস্থিতির অবনতিরোধ প্রবণতা থামা তো দূরের কথা, উল্টো সেসবের অবনতির মাত্রা আরো বেড়ে চলেছে। আর তার চেয়েও বেশি হতাশার বিষয় হলো, এই বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতের ভূমিকার চেয়েও অধিক আগ্রাসী ভূমিকায় রয়েছে রাষ্ট্র নিজেই। 

সরকার ১৯৯৯ সালে যখন সুন্দরবনকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে, তখন এর আয়তন ছিল ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এরও আগে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। আর এ উভয়বিধ ঘোষণার ফলে ধারণা করা হয়েছিল যে সুন্দরবন শুধু রক্ষাই পাবে না, এর বিশাল বিস্তৃত বনভূমি, বন পরিবেষ্টিত নদ-নদী ও কলকাকলীময় জীববৈচিত্র্য আবার তার হৃত সমৃদ্ধি ও গৌরব ফিরে পাবে। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হওয়া তো দূরের কথা, সুন্দরবনকে ইসিএ ঘোষণার এক যুগ পেরোনোর আগেই সরকার সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র (রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র) স্থাপনের জন্য ২০১০ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বসে (স্বাক্ষরকারী সংস্থা ছিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন)। আর তারই ধারাবাহিকতায় সংকটাপন্ন সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেনেও এমওইউ অনুযায়ী, ২০১৬ সালেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপন কাজ শুরু করা হয়। 

এদিকে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনকে ইসিএ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই তখন থেকে এর গাছপালা, নদ-নদী ও প্রাণিকুলের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাড়তি যত্ন, নজর, নিরাপত্তা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করার কথা ছিল, যাতে সেগুলো আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র সেটি করতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, উল্টো পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে বাড়তি হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে এ ধরনের নতুন ক্রিয়াকর্মও শুরু করে দিয়েছে, যার মধ্যে সুন্দরবনের ভেতরে ও সংলগ্ন এলাকায় অবৈধভাবে বহুসংখ্যক শিল্প-কারখানা স্থাপনের অনুমতিদান অন্যতম। কিন্তু যখন দেখা গেল যে বিষয়টি আইনের বরখেলাপ এবং এরই মধ্যে তা আদালতের নজরে চলে এসেছে, তখন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্যোগ নেয়া হলো সুন্দরবনের ইসিএ সন্নিহিত এলাকা থেকে ১০ কিলোমিটার ছেঁটে ফেলা। কী ভয়ংকর উদ্যোগ! রাষ্ট্র যেখানে অবৈধ দখলদারদের উৎখাত বা নিয়ন্ত্রণ করবে, সেখানে উল্টো তারা নিজেরাই দখলদারদের রক্ষার জন্য সুন্দরবনকে ছেঁটে ফেলতে চাচ্ছে। এমনটি বোধহয় কেবল বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব, যেখানে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র কোনো জবাবদিহিতা নেই।

সুন্দরবনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণার পরও সেখানে সংঘটিত নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আংশিক যে বিবরণ ওপরে দেয়া হলো, প্রায় একই অবস্থা অন্য ১২টি ইসিএর ক্ষেত্রেও। অথচ এ এলাকাগুলোকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণাই করা হয়েছিল এলাকাগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে, যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এগুলোকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণার সময় ওই এলাকাগুলোর এ-সংক্রান্ত অবস্থা যেমন ছিল, ঘোষণা-উত্তর গত ২৫ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এর প্রতিটির অবস্থারই সে তুলনায় আরো অবনতি ঘটেছে। অথচ এ সময়ের মধ্যে এগুলোর রক্ষা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নামে রাজস্ব ও উন্নয়ন উভয় বাজেটের আওতায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আর খুব অবাক হতে হয় এটা দেখে যে, ১৩টি ইসিএ-র মধ্যে এ পর্যন্ত একটিকেও জবাবদিহিতাবিহীন এ রাষ্ট্রের লোভী সেবক-কর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করা গেল না। আর রাজনীতিকরাও সেখানে হয়ে গেছেন তাদের পৃষ্ঠপোষক ও সহযোগী। অন্যদিকে দখলদাররা যা করলেন তা তো নতুন কিছু নয়। আমলা ও রাজনীতিকদের সহযোগিতা নিয়ে এটি তারা আরো আগে থেকে যুগ যুগ ধরেই করে আসছে। ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক আমলে তো করেছেনই। দেখে কষ্ট হয় যে, স্বাধীন দেশে সেটি তারা আরো অধিক দাপট ও আস্থার সঙ্গে করার সুযোগ পাচ্ছেন। 

ইসিএ হিসেবে ঘোষিত ১৩টি এলাকার প্রতিটিকে নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করতে গেলে যে ব্যাপক পরিসরের স্থান দরকার, অত্র প্রবন্ধের পরিধি তার জন্য যথেষ্ট নয়। অতএব এলাকাভিত্তিক সে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এখানে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে, উল্লিখিত এলাকাগুলোকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণার ওই উদ্যোগ নিছক কাগুজে দলিল হিসেবে দেশ-বিদেশের অংশীজনদের কাছে তুলে ধরা ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। সুন্দরবন ছাড়াও এ সময়ের মধ্যে ভয়াবহ বিপন্নতার দিকে এগিয়েছে দেশের সমুদ্রসৈকত, পাহাড় ও সমতলের বন, সমুদ্র ও বনের প্রাণিকুল, নদ-নদী, খাল-বিল, বনভূমি ও অন্যান্য জলাশয়। তবে উল্লিখিত এলাকাধীন এসব সম্পদ বিপন্নতার দিকে গেলেও এরই ফাঁকে একটি কাজ কিন্তু ঠিকই হয়েছে—ইসিএ ঘোষণার নাম করে এসবকে উছিলা বানিয়ে কর্তাব্যক্তিদের বিলাসী বিদেশ ভ্রমণ ও যথেচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। অথচ এটি খুবই সম্ভব ছিল যে, ইসিএ ঘোষণা-পরবর্তী এ দীর্ঘ সময়ে ওই এলাকাগুলোর হৃত শ্রী অনেকটাই পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে।

উল্লিখিত এলাকাগুলোকে ইসিএ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পর এগুলোর সুরক্ষা ও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে এগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে এক্ষেত্রে একেবারে প্রথম ধাপের একটি বড় কাজ হওয়া উচিত ছিল প্রতিটি অঞ্চলের আওতাধীন প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা। কিন্তু সেটি করা তো দূরের কথা, তা করা যে একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ, সে বোধটিও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কতটা স্পষ্ট, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অথচ সত্য যে এটি করতে না পারলে বা করা না হলে ইসিএ-ভিত্তিক অন্য যত কাজই করা হোক না কেন, সেগুলো হবে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ও লক্ষ্যবিহীন। এ অবস্থায় বিলম্বে হলেও ওই কাজ অর্থাৎ ওই সম্পদের তালিকা তৈরি করে সেগুলোর সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য উপযুক্ত কর্মকৌশল ও কর্মসূচি নিয়ে এগোনো অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে ওই তালিকায় বিদ্যমান সম্পদের পাশাপাশি বিলুপ্ত বা হারিয়ে যাওয়া সম্পদের নামধাম এবং বিবরণও অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক, যাতে এ-সংক্রান্ত পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রণীত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিধারণ সহজ হয়।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে ১৩টি এলাকা ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই হচ্ছে জনপরিচিত এবং কিছুটা নগরকেন্দ্রিক এলাকা। কিন্তু এর বাইরেও দেশে এমন আরো বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রয়েছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে যেগুলো বহু বছর ধরেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ফলে ওই এলাকাগুলোকে আরো বহু আগেই ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত ছিল। এ ধরনের এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ভাওয়ালের গড়, মধুপুরের গড়, বেলাই বিল, ব্রহ্মপুত্র নদ, তুরাগ ও ধলেশ্বরীসহ অনেক নদ-নদী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির পাহাড়ি বনাঞ্চল ইত্যাদি। সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝঁকিপূর্ণ এ ধরনের এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করা। মহামান্য হাইকোর্ট যে ধরনের বিবেচনা থেকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার উপযুক্ত পণ্যগুলোর তালিকা তৈরি করে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, সেই একই ধরনের বিবেচনা থেকে সরকারের উচিত হবে ইসিএ হিসেবে ঘোষণার উপযুক্ত স্থানগুলোরও একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পরিস্থিতির উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উল্লেখ্য যে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিবেচনা থেকে বিপন্ন ও বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে থাকা এলাকাকে ইসিএ-ভুক্তির ব্যবস্থা পৃথিবীজুড়েই চালু আছে। আর যেসব দেশে এ ধরনের বিপন্ন এলাকার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্যদিকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণার পরও যেসব দেশে ইসিএ-ভুক্ত এলাকাগুলোর উন্নয়নের গতি সবচেয়ে মন্থর অথবা নিম্নমুখী, তার মধ্যেও বাংলাদেশই শীর্ষে। অথচ বিভিন্ন বিশ্ব ফোরামে গিয়ে বিশ্বের জলবায়ু, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এ দেশের শীর্ষব্যক্তিরা এমনসব আবেগঘন বড় বড় কথাবার্তা বলছেন যা তাদের আচরণের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। তাছাড়া তাদের এসব কথাবার্তার মধ্যে এমন কথাও রয়েছে যে শিল্পোন্নত দেশগুলোই পৃথিবীতে জলবায়ু ও পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। ফলে এ-সংক্রান্ত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদেরই উচিত জলবায়ু তহবিলে সবচেয়ে বেশি অর্থ জোগানো। বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের শেষোক্ত এ বক্তব্য খুবই যথার্থ। কিন্তু তাদের এসব যথার্থ বক্তব্য তখনই প্রহসনে রূপান্তরিত হয়, যখন জলবায়ু, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা সংক্রান্ত তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশটি সবচেয়ে বেশি অদক্ষতা ও দুর্নীতিপরায়ণতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কোনোরূপ উন্নতি সাধন করা তো দূরের কথা, উল্টো সে পরিস্থিতিকে আরো অধিক বিপন্ন করে তোলে। চরম কষ্ট ও হতাশার বিষয় এই যে ইসিএ ঘোষিত এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে বিপন্নতার এ মাত্রা আরো বেশি প্রকট এবং দিনে দিনে তা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।

আবু তাহের খান: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন