অভিমত

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হোক আসন্ন মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য

আনোয়ার ফারুক তালুকদার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের টানা নয় মাস দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে তা ১২ শতাংশের কাছাকাছি বা ওপরে হবে। এ অবস্থা বিবেচনায় ২০২২ সালের ১০০ টাকার পণ্য কিনতে ২০২৩ সালে ভোক্তার ব্যয় করতে হয়েছে ১০৯ টাকা। ভেবে দেখা দরকার, সেই অনুপাতে মজুরি বেড়েছে কত টাকা। মানুষের জীবনযাপন ব্যয়কে ২০২২ সালের মতো রাখতে চাইলেও ২০২৩ সালে কমপক্ষে ৯ ভাগ মজুরি বৃদ্ধি দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়েছে? যেকোনো দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার মূল কাজ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক হলো আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এ ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ হচ্ছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা মূল অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার অর্থাৎ অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে নীতি সুদহার বাড়িয়ে বা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি করতে হয়, কিন্তু আমাদের কাছে অনেক দিন এটি অকার্যকর ছিল। এ কাজটি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগ। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হচ্ছে এটি। আমাদের এখানে আগে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন। এবারের কমিটিতে বাইরে থেকে আরো তিনজনকে রাখা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গভর্নরসহ মুদ্রানীতি বিভাগের ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক থাকবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে থেকে কমিটিতে থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) একজন প্রতিনিধি। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতি নতুন কমিটির মাধ্যমেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৫ জানুয়ারি চলমান প্রান্তিকের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। এবার মুদ্রানীতিতে অবশ্যই আগেরকার মুদ্রানীতির চাইতে নতুন কিছু পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। আসন্ন মুদ্রানীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। অনেকেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মতামত প্রকাশ করছেন। এবারের মুদ্রানীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমত, দেশে মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেড়ে আছে, নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে পৌঁছেছে। অবশ্য অক্টোবরে এটি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অন্যদিকে রিজার্ভ দিন দিন কমছে; এক সময়ে ৪৮ বিলিয়নের রিজার্ভ ছিল। এখন তা অর্ধেকেরও কম, তারল্য নিয়ে একটি বাড়তি উদ্বেগ রয়ে গেছে, করোনার জন্য কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে খেলাপি ঋণ বিগত বছরে কম ছিল, কিন্তু এবার খেলাপি ঋণ বেড়ে দেড় লাখ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছে গেছে। নতুন সুদহার স্মার্ট চালু হওয়ার পর থেকে মাসে মাসে সুদের হার বেড়ে চলছে। সর্বশেষ ডিসেম্বরে স্মার্ট সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ ভাগ, তাতে করে ব্যবসায়িক ঋণের সুদের হার ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে পৌঁছবে। এর ফলে দিন দিন ঋণ অনেক দামি হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি পাবে। এসব সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ঠিক রাখতে গিয়ে মুদ্রানীতি একটু ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ার দাবি রাখে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধ, রিজার্ভ বাড়ানো এবাবের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ দফায় দফায় ১৫ বার নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। তেমনি শ্রীলংকা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও একই পথে হাঁটা শুরু করেছে। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে মুদ্রাস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নেমে আসবে। তবে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দিলে ঋণপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে তাতে করে উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। আমাদের দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হওয়ার কথা নিয়মিতই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। এ পাচার হওয়া টাকা কীভাবে ফেরত আনা যায় তার একটি পথনকশা দরকার। রিজার্ভ নিয়ে যে শঙ্কায় দেশ পতিত হয়েছে তা থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে হবে। বৈধ পথে রেমিটেন্স আনার সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার। খেলাপি ঋণ আদায়ের কৌশল বাস্তবায়ন দরকার। ঋণ কেন খারাপ হচ্ছে তার অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আমাদের দেশ আমাদেরই ঠিক রাখতে হবে। দেশের স্বার্থে সব ভেদাভেদ ভুলে সুশাসন এবং সহাবস্থান নিশ্চিতে সবাইকে ছাড় দেয়ার মনমানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

আনোয়ার ফারুক তালুকদার: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও চিফ এসএমই বিজনেস অফিসার, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন