উনি রাজনৈতিক চাপের কোনো তোয়াক্কা করেননি

ড. ফাহমিদা খাতুন

ড. এ. বি. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। ওনার সঙ্গে আমার প্রায় ২০ বছরের পরিচয়। আমার পেশাগত ও ব্যক্তিগতভাবে ওনার সঙ্গে পরিচয়। বিশেষ করে পেশাগতভাবে আমরা সিপিডিতে বিভিন্ন গবেষণা যখন করি ওনার মতামত, সাজেশন বা সুপারিশ আমরা অনেক গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে এসেছি। আমাদের সিপিডির যে একটা গবেষণা, এটা যে একটা প্রকল্প, আমরা এটাকে ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম বলি— ইনডিপেনডেন্ট রিভিউ অব বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি স্বাধীন পর্যালোচনা। এর অধীনে আমরা সারা বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করি, বাজেট বিশ্লেষণ করে থাকি। তখন আমরা এ বিশ্লেষণগুলো তৈরি করার আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসি, তাদের কাছে রিপোর্টটা আগে পাঠাই দেখার জন্য। মির্জ্জা আজিজ এ কাজগুলো খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে এবং সময় নিয়ে করতেন। প্রতিটি বিষয় তিনি খুব বিস্তারিতভাবে দেখতেন এবং সাজেশনগুলো দিতেন। যার কারণে আমাদের আইআরবিডির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণগুলো এত উন্নত হয়েছে, আরো শক্তিশালী হয়েছে।

তারপর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হলেন, তখনো কিন্তু কোনো  গবেষণাপত্র লিখলে বা ওনার কাছে পাঠালে উনি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। আমার মনে পড়ে, আমি নিজে একটা কাজ করেছিলাম, সেটা হলো বৈদেশিক সাহায্যের ইফেক্টিভনেস অর্থাৎ কার্যকারিতা। আমাদের মতো দেশে বৈদেশিক সাহায্যের কার্যকারিতা কীভাবে বাড়ানো যায়। ডোনারদের পক্ষ থেকে কী কী করার আছে, নিজেদের পক্ষ থেকে কী কী করার আছে, এটা নিয়ে একটা গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলাম। তার আগে আমরা যখন ডায়ালগ করি, ওনাকে কাজটা পাঠিয়েছিলাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে পুরো গবেষণাটি পড়েছিলেন। আমাদের অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। উনি এ কাজের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও বলেছিলেন এটা কাজে লাগে কিনা দেখতে। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ফোনও পেয়েছিলাম, তারা বসতে চেয়েছিল আর বিভিন্ন সময়ে তারা আলোচনা করেছিল যে বৈদেশিক সাহায্যের আলোচনার বিষয়ে যদি কিছু থাকত তাহলে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করত। ওনার নিষ্ঠা ও সততা সবকিছু ওনার পেশাগত জীবনজুড়েই ছিল, সেটা তিনি যত বড় অবস্থানেই থাকেন না কেন। 


তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখনো ওনার সততা দেখেছি। রাজনৈতিক চাপ সরিয়ে দিয়ে তিনি পেশাগত নিষ্ঠা ও নীতিমালাতে গুরুত্ব দিয়েছেন। উনি রাজনৈতিক চাপেরও কোনো তোয়াক্কা করেননি। যেটা ওনার নীতির সঙ্গে যায় না, সেটার তিনি তোয়াক্কা করেননি। 

এমনকি রাজনৈতিক সরকারের আমলেও তিনি এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করেছেন। তারপর তিনি একজন শিক্ষক, তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আমি শুনেছি তিনি তার শিক্ষার্থীদের অনেক জটিল বিষয় সহজভাবে বুঝিয়ে দেন। সবাই বলেছে তার ক্লাসে তারা অর্থনীতির মতো জটিল বিষয় খুব সহজেই বুঝতে পারে। 

তিনি জাতিসংঘে অনেকদিন কাজ করেছেন। তারপর উনি যখন বাংলাদেশে চলে এলেন, বাংলাদেশে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন। যেমন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, এগুলো সবই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পজিশন। সে কাজগুলো তিনি অনেক নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে করেছেন। সেখানে সাফল্যও দেখিয়েছেন। আমাদের বিভিন্ন ডায়ালগে তিনি আসেন। আমাদের জাতীয় ডায়ালগে এবং ইন্টারনাল যে আলোচনাগুলো হয় সেগুলোয়ও আসেন। উনি সবসময় তথ্য ও বিশ্লেষণ দুটোর সমন্বয় করেন। উনি তথ্য ছাড়া কখনই কথা বলেন না। তথ্য দিয়ে উনি ওনার বিশ্লেষণকে আরো শক্ত করেন। উনি যখনই কথা বলেন এত বছর পরও মনে হয় শিখছি—কীভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়কে দেখতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয়। সেদিক থেকে আমি বলব তিনি পেশাগত জীবনে, শিক্ষক হিসেবে, নীতিনির্ধারক হিসেবে একজন অত্যন্ত সফল ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি একজন সহজ মনের মানুষ। খুব ধীরস্থির, কখনই কারো সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেননি। রাগ হওয়া বা ওই রকম ব্যবহার ওনার কাছ থেকে দেখিনি। আমি ওনাকে পেশাগত ও ব্যক্তিগতভাবেও দেখেছি। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যখন কোনো বড় একটা অবস্থানে পৌঁছান, তখন তাদের আচার-ব্যবহারে সেটার একটা প্রতিফলন থাকে। কিন্তু উনি অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র একজন মানুষ।

ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন