ভূরাজনীতি

অভিবাসন ঠেকাতে বাইডেন কি ট্রাম্পের পথে হাঁটছেন?

মোহাম্মদ জমির

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন টেক্সাস সীমান্তে নতুন প্রাচীর নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। এর পর থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন। স্টার কাউন্টিতে প্রায় ২০ মাইলজুড়ে এ প্রাচীর নির্মাণের কথা। এটি রিও গ্র্যান্ডে পার্বত্য সীমান্ত। এখানে খুব বেশি মানুষ বসবাস করে না। যদিও বাইডেন ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিজয়ী হলে তিনি আর এক ফুট প্রাচীরও নির্মাণ করবেন না।

এখন এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, ‘এবার প্রমাণ হলো, আমিই সঠিক ছিলাম।’

স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, ইউএস বর্ডার প্যাট্রল গত আগস্টে দক্ষিণ সীমান্ত থেকে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫৯ জনকে গ্রেফতার করে, যা জুলাইয়ে ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৪৮ জন। এ অভিযান শুরু হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। প্রশাসন ঘোষণা করেছে, ভেনিজুয়েলার অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হবে। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে পৌঁছায়।

বাইডেন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত সমালোচনার মুখে পড়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন একে ‘গভীর ব্যর্থতা’ বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটির সীমান্ত কৌশল বিভাগের পরিচালক জোনাথন ব্লেজার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার পরিবর্তে বাইডেন অতীতের ব্যর্থ নীতিগুলোকে জোরালো করেছে। অথচ এটা অনেক আগে অপব্যয় ও অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।’

এ বিতর্কিত বিলে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি থাকাকালে স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন বাইডেন বলছেন, তিনি এটা ‘বন্ধ করতে পারবেন না’। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জানিয়েছে, এ ধরনের প্রাচীর নির্মাণের ঝুঁকিগুলো বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে একটি প্রতিবেদনের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেখানে দেখানো হয়েছে, কর্তৃপক্ষ শুধু এ অর্থবছরে ২২ লাখ অভিবাসীকে আটক করেছে। এটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ও অভিবাসন সমস্যা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একটি ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। জনসংখ্যাবিদ জোসেফ চ্যামির মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশী বংশোদ্ভূত বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটিতে পৌঁছেছে। এটি অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভুল বার্তা দিতে পারে।’

এ বিতর্ক ক্রমে তীব্র হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর ৮০০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ মার্কিন নাগরিক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়েই গড়ে উঠেছে আজকের এ আমেরিকা। পৃথিবীর মোট অভিবাসীর প্রায় ১৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বিদেশী বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৪ কোটি ৪০ লাখের চেয়ে বেশি। আজকের সংখ্যাটি ১৯৬৫ সালের অভিবাসী সংখ্যার তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ। ওই বছর অভিবাসন ও জাতীয়তা আইন পাস করা হয়েছিল। এটি স্মরণ করা যেতে পারে যে এ আইন একটি নতুন নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এটা উচ্চদক্ষ অভিবাসী এবং যাদের পরিবার এরই মধ্যে এ দেশে বসবাস করছে, তাদের অগ্রাধিকার দেয়। আইনটি লক্ষাধিক অ-ইউরোপীয় অভিবাসীর যুক্তরাষ্ট্রে আসার পথ প্রশস্ত করে দেয়।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পাঁচটি অভিবাসী গোষ্ঠী হচ্ছে ক্রমানুযায়ী ইতালি, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও পোল্যান্ড। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ২০১৫ সালে অভিবাসীদের বৃহত্তম গোষ্ঠীর মধ্যে মেক্সিকো শীর্ষে। এরপর ক্রমান্বয়ে ভারত, চীন, ফিলিপাইন ও এল সালভাদর। বিদেশী বংশোদ্ভূত কর্মীর সংখ্যা ২০২২ সালে প্রায় তিন কোটির রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক শ্রমশক্তির ১৮ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন প্রায় পাঁচ লাখ ভেনিজুয়েলান অভিবাসীকে ১৮ মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কাজ ও বসবাস করার সুযোগ দিয়েছিল। তখন এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। এ ক্রমবর্ধমান জটিলতা গত ১০ বছরে আরো খারাপ হয়েছে। এটা হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের অনুমতিপ্রাপ্তদের কারণে।

বিভিন্ন দেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী পরিবার মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে। ইউএস বর্ডার প্যাট্রল ২০২৩ সালের আগস্টে একটি পারিবারিক গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে সীমান্ত অতিক্রমকারী প্রায় ৯২ হাজার অভিবাসীকে গ্রেফতার করে। এটা ২০১৯ সালের মে মাসে প্রায় ৮৫ হাজারের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

এটা লক্ষণীয় যে বিদেশী বংশোদ্ভূতদের আনুপাতিক সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে চোখে পড়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি বিদেশী বংশোদ্ভূত। এরপর ক্রমান্বয়ে রয়েছে নিউজার্সি, নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা ও হাওয়াই। এসব রাজ্যে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বিদেশী বংশোদ্ভূত। বিপরীতে পশ্চিম ভার্জিনিয়া, মিসিসিপি, মন্টানা, ওয়াইমিং ও সাউথ ডাকোটায় জনসংখ্যার ৪ শতাংশেরও কম বিদেশী বংশোদ্ভূত। অননুমোদিত সীমান্ত পারাপার বেড়ে যাওয়াটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

মজার বিষয় হলো, দক্ষিণ সীমান্ত অভিবাসীদের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তাদের গন্তব্য হলো নিউইয়র্ক সিটি। যেখানে সম্প্রতি এক লাখেরও বেশি অভিবাসীর আগমন ঘটেছে। আশ্রয় কেন্দ্র, পরিষেবা ও স্থানীয় সেবাপ্রতিষ্ঠানকে অভিভূত করার পাশাপাশি অভিবাসনবিরোধী করে তুলেছে।

বোস্টন, শিকাগো, ডেনভার, ফিলাডেলফিয়া, পোর্টল্যান্ডসহ যুক্তরাষ্ট্রের আরো কয়েকটি শহরেও একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সম্ভাব্য কর্মসংস্থানের সুযোগের কারণে এ শহরগুলোয় বিপুলসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী আসছে। এরা স্থানীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং বাজেটকে প্রভাবিত করছে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠীগুলোকে চাপে ফেলছে।

যা হোক, যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানের অনুমতি পাওয়া বিদেশী বংশোদ্ভূত এবং দক্ষিণ সীমান্তে প্রবেশকারী অননুমোদিত অভিবাসীদের বিবেচনায় নেয় না। অনেক জনসংখ্যাবিদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে অননুমোদিত অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে ২০৬০ সালে বিদেশী বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা আট কোটি হবে, যা আমেরিকার আনুমানিক জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশের কাছাকাছি।

এটা স্পষ্ট যে এ হার কয়েকটি দিক থেকে চিন্তার কারণ, যা বাইডেন প্রশাসনের জন্য আসন্ন পুনর্নির্বাচনের সময় সমস্যা তৈরি করতে পারে।

অভিবাসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও আলোচনায় এসেছে। চলতি অক্টোবরে ইউরোপ ধীরে ধীরে ডান দিকে সরে যাচ্ছে। ফলে অভিবাসন নীতিতে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইইউ রাষ্ট্রগুলো বছরের শেষ নাগাদ সংশোধিত অভিবাসন নীতির মাধ্যমে অনিয়মিত অভিবাসন গ্রহণের জন্য একাধিক নতুন পদ্ধতিতে সম্মত হয়েছে৷

উল্লেখ করা যেতে পারে, সাম্প্রতিক অতীতে ইউরোপের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হাজার হাজার শরণার্থী যুদ্ধ, সংঘাত ও অর্থনৈতিক কষ্ট থেকে পালিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছে।

মনে রাখতে হবে, ইউরোপ অভিবাসী গ্রহণ করে ডাবলিন রেগুলেশনের ভিত্তিতে। চুক্তিটি ১৯৯০ সালে স্বাক্ষর হয়েছিল। তিনবার সংশোধন করা হয়েছে। কোন সদস্যরাষ্ট্র কোন আশ্রয়ের আবেদন যাচাই করবে, এ চুক্তিতে তা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সীমান্তে কীভাবে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রক্রিয়াকরণ হয় এবং কীভাবে তাদের ইউরোপজুড়ে স্থানান্তর করা হয়, তা পরিবর্তনের জন্য একটি নতুন প্রবিধান তৈরি করা হয়েছে। ডাবলিন রেগুলেশন আগামীতে বাতিল করা হতে পারে।

আগামী বছর ইইউ নির্বাচনের আগে পরিবর্তনগুলোকে আইনত বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করছে ২৭ সদস্যরাষ্ট্র। সুইডিশ অভিবাসনমন্ত্রী মারিয়া মালমার স্টেনারগার্ড বলেছেন, ‘ইইউ সীমান্তে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং অবৈধ অভিবাসীর ঢল ঠেকাতে চুক্তি কার্যকর করা গুরুত্বপূর্ণ।’

ইইউর মন্ত্রীরা আশ্রয়ের পদ্ধতিগুলো সংশোধন করাতে সম্মত হয়েছেন, যা প্রায় ১০ বছর ধরে সবাই এড়িয়ে গেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইতালি ও গ্রিসের কাছ থেকে সাড়া পেয়ে ১২ ঘণ্টা আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা স্পষ্টত একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন। যার লক্ষ্য ২০১৫ সালের হিসাব চুকিয়ে ফেলা। ওই সময় ১০ লাখ ব্যক্তি ইউরোপে ঢুকেছে, যার বেশির ভাগ সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা।

তবে এটা বোঝা দরকার, ইইউর ব্যাপারে নির্ধারিত পরিবর্তনের বিষয়ে সম্পূর্ণ চুক্তিটি ঐকমত্যের কারণে নয়। ইতালি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও জার্মানির মতো দেশগুলোয় ডানপন্থী দলগুলো অভিবাসন ঠেকানোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আশ্রয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। আরো বেশি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এটাও উল্লেখ করা দরকার যে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড পরবর্তী নির্বাচনের পর ইইউর প্রেসিডেন্ট পদে ক্রমান্বয়ে বসবে। দুই দেশই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। ফলে ভোটটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়নি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সমর্থন পেয়েছে।

তা সত্ত্বেও ইইউ এমন ব্যবস্থা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ইতালির মতো দেশগুলোর সমর্থন পাবে। যেখানে অনেক শরণার্থী ভূমধ্যসাগরের পাশাপাশি ইইউর বাইরের সীমান্তে যাচাই কেন্দ্রগুলো থেকে আসে। ইতালীয় কর্তৃপক্ষ অতীতের মতো নয়। আশ্রয়প্রার্থীদের আটকে রাখে। কারণ তাদের দাবিগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এ প্রক্রিয়া বিশ্বজুড়ে অনেক মানবাধিকার কর্মীর মধ্যে বিতর্ক উসকে দিয়েছে। আশ্রয় সীমাবদ্ধ করা এবং অভিবাসন রোধ করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার উপেক্ষা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর প্রভাব পড়েছে।

এটি এখন বিশ্বাস করা হয় যে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অভিবাসন বিধিনিষেধের অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো আউটসোর্সিং চুক্তির ফলে হয়েছে।৷ সম্প্রতি তিউনিসিয়ার মরুভূমিতে শরণার্থী এবং অভিবাসীদের ফেলে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে, যা কারো কাম্য হতে পারে না।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, তথ্যের অধিকার এবং সুশাসন বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন