আলোকপাত

কৃষিপণ্যের রফতানি কেন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে পারছে না

মো. আবদুল লতিফ মণ্ডল

শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বন উপখাতগুলো নিয়ে দেশের সার্বিক কৃষি খাত গঠিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান অনেকটা হ্রাস পেলেও এখনো কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি। সরকারি তথ্যানুযায়ী, চাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। পাট উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় এবং বদ্ধ জলাশয় উভয় ক্ষেত্রে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় এবং সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। ফলের রাজা আম উংপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে। এ সত্ত্বেও কৃষিজাত পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এসব কারণ পর্যালোচনা এবং সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।   

বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রচলিত ও অপ্রচলিত কৃষিপণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা, চিংড়ি ও মৎস্যজাত পণ্য, হালাল মাংস, মাংসজাত পণ্য, সবজি, আলু, পান ফলমূল, ড্রিংকস, বিস্কুট, চানাচুর, সেমাই, পটেটো ফ্লেকস, নুডলস, ড্রাই কেক, মুড়ি, চিড়া ইত্যাদি। রফতানি নীতি ২০২১-২৪-এ শর্ত সাপেক্ষে রফতানি পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, চিনি, ইলিশ মাছ, সুগন্ধি চাল এবং মোটা দানার মুগ ডাল। যেসব কৃষিপণ্য রফতানিনিষিদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেগুলো—এক. প্রক্রিয়াজাত ডাল ব্যতীত সকল প্রকার ডাল; দুই. চিল্ড, হিমায়িত ও প্রক্রিয়াজাত ব্যতীত অন্যান্য চিংড়ি; তিন. পেঁয়াজ, রসুন, আদা; চার. সকল প্রকার ব্যাঙ (জীবিত বা মৃত) ও ব্যাঙের পা। 

প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক যেসব দেশে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম, জার্মানি, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, সুদান, ইরান ও ইরাক। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ৬০ দেশে হিমায়িত মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে  ইউকে, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস, পর্তুগাল, রাশিয়া, ইউএসএ, জাপান, চায়না, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারত। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ৬০ দেশে হিমায়িত মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইউকে, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, স্পে, গ্রিস, সাইপ্রাস, পর্তুগাল, রাশিয়া, ইউএসএ, জাপান, চায়না, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারত। যেসব দেশে শাকসবজি রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও নেপাল। যেসব দেশে ফল রফতানি হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— কাতার, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, সৌদি আরব ও অস্ট্রেলিয়া। 

চলমান রফতানি নীতির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতে পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়জাত কৃষিপণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত বলতে সেসব খাতকে বোঝায় যেখানে রফতানির বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে অথচ বিবিধ কারণে এ সম্ভাবনাকে তেমন কাজে লাগানো যায়নি, তবে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিলে অধিকতর সাফল্য অর্জন সম্ভব। অনুরূপভাবে বিশেষ উন্নয়ন খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য চিহ্নিত  কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে জীবন্ত ও প্রক্রিয়াজাত কাঁকড়া, হালাল মাংস, মাংসজাত পণ্য ও অন্য হালাল পণ্য। উল্লেখ্য, যেসব পণ্যের রফতানি সম্ভাবনা রয়েছে অথচ পণ্যগুলোর উৎপাদন, সরবরাহ এবং রফতানি ভিত্তি সুসংহত নয়, সেসব পণ্যের রফতানি ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।        

কৃষি মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘কৃষিপণ্য রফতানি রোডম্যাপ ২০০০’ অনুযায়ী, সতেজ ও প্রক্রিয়াকরণ কৃষিপণ্য রফতানি প্রধান সমস্যাগুলো হলো— এক. কাঙ্ক্ষিত জাতের অভাব; দুই. নিরাপদ ও মানসমন্ন পণ্যের অভাব; তিন. কার্গো ও বিমানে কৃষিপণ্যের জন্য অপ্রতুল স্থান; চার. প্রয়োজনীয় টেস্ট করার জন্য পর্যাপ্ত ল্যাবের অভাব; পাঁচ. অ্যাক্রিডেটেড ল্যাবের অভাব; ছয়. টেস্ট করতে সময় ও চার্জ বেশি; সাত. কুল চেইন সিস্টেম অনুপস্থিত; আট. প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালের ওপর অধিক করারোপ; নয়. আমদানিকারক দেশগুলোর পণ্যবিষয়ক আবশ্যকীয় তথ্যের অভাব। 

এটা অনস্বীকার্য যে দিন দিন কৃষিপণ্যের রফতানির পরিমাণ বাড়ছে। সরকার কৃষিপণ্য রফতানির জন্য ২০ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করছে। তবে কৃষিপণ্যের রফতানির পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। তাছাড়া কোনো কোনো কৃষিপণ্যের রফতানি আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না।  বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা২ ০২৩-এ কিছু পণ্যের রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির উল্লেখ রয়েছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ২০২১-২২ অর্থবছরে কাঁচা পাট রফতানি থেকে আয় হয় ২১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি। আবার ২০১২-১৩ অর্থবছরের আয়ের তুলনায় তা ১৪ মিলিয়ন ডলার কম। হিমায়িত খাদ্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে হিমায়িত খাদ্য রফতানি থেকে আয় হয় ৫৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যথাক্রমে ৫৪৪, ৬৩৮, ৫৬৮ এবং ৫৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের তুলনায় কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিজ পণ্য রফতানি থেকে আয় ৫০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের আয়ের তুলনায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩)। 

কৃষিপণ্যের রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং আয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— ক. পাটের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অন্যসব কৃষিপণ্যের মতো পাট পণ্যকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে চাষাবাদে কৃষককে উংসাহিত করতে হবে। খ. হিমায়িত মৎস্যজাত পণ্য রফতানিতে চিংড়ির অবস্থান শীর্ষে। তাই চিংড়ি চাষে এবং রফতানির জন্য চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। গ. রফতানির জন্য গুণগত মানসম্পন্ন এবং নিরাপদ সবজি ও ফলমূল উৎপাদনের বাস্তবায়ন কৌশল হিসেবে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং প্রচলনের ওপর ‘কৃষিপণ্য রফতানি রোডম্যাপ ২০০০’-এ জোর দেয়া হয়েছে। এর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। ঘ. পচনশীল পণ্য হিসেবে তাজা শাক-সবজি, ফলমূল, ফুল, উদ্ভিদজাত ও প্রাণিজ পণ্যের গুণগতমান ও সজীবতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা স্থাপন নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে চলমান রফতানি নীতিতে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ঙ. কৃষিপণ্য রফতানিতে নগদ প্রণোদনা এবং নীতিগত অগ্রাধিকার দেয়া সত্ত্বেও মানসম্মত পরীক্ষাগারের অভাব ও দুর্বল প্যাকেজিংয়ের মতো বেশকিছু কারণে বাংলাদেশ এ খাতের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের আশু দৃষ্টি প্রয়োজন। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার তৈরির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চ. বিমানে কৃষিপণ্য রফতানির স্পেস বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের জন্য বিমানবন্দরে পৃথক গেট ও স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের মতো সমস্যার সমাধান জরুরি ভিত্তিতে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। ছ. পাটজাত পণ্যসহ অন্য কৃষিপণ্য রফতানিকারকের অনুকূলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদ, সার্ভিস চার্জে ঋণ সুবিধা প্রদানে এগিয়ে আসবে। জ. আমদানিকারক দেশগুলোর পণ্যবিষয়ক আবশ্যকীয় তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ এবং কৃষিপণ্যসহ অন্য পণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতে  বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

মো. আবদুল লতিফ মণ্ডল: সাবেক খাদ্যসচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন