দেশের ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার স্থিতি কিছুটা বেড়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর দায়ের তুলনায় ডলার সরবরাহ অনেকটাই কম। ফলে আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) দায় মেটাতে এখনো ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। এতে দিন যত যাচ্ছে রিজার্ভের ক্ষয়ও তত বাড়ছে। চলতি জুলাইয়ের ২৬ দিনেই রিজার্ভে ক্ষয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫২ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ২৬ জুন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে রিজার্ভ ডলারের স্থিতি ছিল ৫৫৩ কোটি ডলার, যা মে মাসের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। যদিও জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৯৭ কোটি ডলার ছিল ডেফার্ড পেমেন্ট বা বিলম্বিত দায়। মূলত যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের এ বিদেশী ঋণ তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এ তিন মাসে ১ হাজার ৪৩৮ কোটি ডলারের নতুন এলসি খোলা হবে। এর মধ্যে ব্যাক টু ব্যাক এলসির সম্ভাব্য দায়ের পরিমাণ হবে ২৫০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক আমদানির এলসি দায় পরিশোধে প্রতিদিনই ব্যর্থ হচ্ছে। এসব ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ দায়ের পরিমাণ এখন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। সরকারি এলসির পাশাপাশি বেসরকারি খাতের এলসি দায়ও পরিশোধ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। দিনের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার সংগ্রহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ধরনা দেয়া। প্রতিদিনই এ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিলিয়ন ডলার কেনার প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্রির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ কোটি ডলারে সীমাবদ্ধ থাকছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ার লক্ষণ এখনো স্পষ্ট নয়। বরং আমদানির এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোর তিক্ততা বাড়ছে। বিদেশী বড় ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর জন্য নিজেদের ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কর্তৃক বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দেয়ার পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। আগামীতে দেশে ডলারের বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘ডলারের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সংকট মোটেই কমেনি। আমরা এখনো চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসি খুলতে পারছি না। ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকার কারণে আন্তঃব্যাংকে ডলার বেচাকেনা চালু হচ্ছে না।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে বলে গভর্নর মহোদয় জানিয়েছেন। আমরা সেটি দেখার প্রত্যাশায় আছি। ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে পারে। পাশাপাশি রফতানি আয়েও উন্নতি হবে। তখন ব্যাংকগুলোর ডলার পরিস্থিতিও উন্নতি হতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে থাকা ডলারের রিজার্ভ ছিল ৬০০ কোটি বা ৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে দেশে ডলারের সংকট বাড়তে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো হিসাবে ডলারের পরিমাণও কমে যায়। গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকগুলোর এ রিজার্ভের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। চলতি বছরের ২৬ জুন ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে রিজার্ভ স্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর এ রিজার্ভ ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংকগুলো মূলত আমদানির এলসি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য বিদেশী হিসাব বা নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ডলার সংরক্ষণ করে।
রিজার্ভের অব্যাহত ক্ষয় ও ডলার সংকটের কারণে বিদেশী অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের বেসরকারি খাত থেকে নিজেদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ কারণে গত ছয় মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ২৭৬ কোটি ডলার কমেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে এ ধরনের বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ স্থিতি ১৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর বিলম্বিত এলসি দায় বা ডেফার্ড পেমেন্ট না কমে উল্টো বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ডেফার্ড পেমেন্টের স্থিতি ছিল ৬৯ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে বিলম্বিত এ দায়ের স্থিতি ৯৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি অন্য বিদেশী ঋণের মধ্যে ৭৬৯ কোটি ডলার হলো বায়ার্স ক্রেডিট। এছাড়া সরাসরি স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ হলো ৩৫৪ কোটি, ব্যাক টু ব্যাক এলসি ৮৪ কোটি ও অন্যান্য দায় ৬০ কোটি ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পার করেছে বাংলাদেশ। ওই বছর রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এ অবস্থায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সংকটের পাশাপাশি এলসি খোলার শর্ত কঠোর করায় আমদানির পরিমাণ ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কমে এসেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ৬৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আর পণ্য রফতানি হয়েছে ৪৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থবছরের ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকগুলোর এলসি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধে শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। চলতি জুলাইয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত চলতি মাসেই রিজার্ভ থেকে বিক্রির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেকোনো দেশের অর্থনীতিতেই কিছুটা শঙ্কা ও উদ্বেগ থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় আছে। বিপরীতে আমদানি ব্যয় অনেক কমে এসেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগের মতো বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে না। আমি মনে করি, জাতীয় নির্বাচনের পর ডলার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট—এ তিন মাসে কী পরিমাণ আমদানির এলসি খোলা হতে পারে, সেটি প্রক্ষেপণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যাচ্ছে, জুনে ৪৮৯ কোটি, জুলাইয়ে ৪৭৫ কোটি ও আগস্টে ৪৭৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হতে পারে। অর্থাৎ এ তিন মাসে মোট ১৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলার প্রাক্কলন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এ তিন মাসে ২৫০ কোটি ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হতে পারে। যদিও জুন ও জুলাইয়ে এরই মধ্যে প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি এলসি খুলেছে ব্যাংকগুলো।
একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে এ মুহূর্তে প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলার চাহিদা রয়েছে। সেখানে যদি মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে নানা উপসর্গ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। এভাবে জোর করে দীর্ঘদিন আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকাতে হলে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’