আলোকপাত

বাংলাদেশে উচ্চতর কৃষি শিক্ষার সংস্কার প্রসঙ্গ

আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ

কৃষিই কৃষ্টি! কৃষিই সমৃদ্ধি! কৃষিকে ঘিরেই মানবসভ্যতার জাগরণ শুরু। ‘‌কৃষি’ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আদিতম বিষয়গুলোর অন্যতম। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সংশ্লিষ্টতায় কৃষির বিকল্প নেই। কৃষিই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকাংশ উপাদান আসে এ কৃষি থেকেই। ফসল উৎপাদন, পশুপাখি পালন, মাছ চাষ এবং বনায়নের জন্য মাটির জৈবিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনাই হলো কৃষি। কৃষিকাজ মানবজাতির আদিতম পেশা। এ কৃষিকার্য প্রচলনের ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরনো।

কৃষিশিক্ষা কৃষিসংশ্লিষ্ট শিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর কৃষিশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কৃষিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কৃষিতে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করে থাকে এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের দুটি সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ এবং সিরাজগঞ্জ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) অধিভুক্ত করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশে মোট ১৮টি সরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা এটিআইতে (এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) এবং ১৬২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার (চার বছর মেয়াদি) কৃষি ডিপ্লোমা কোর্সটি করার সুযোগ রয়েছে।

যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান; ফলিত কৃষি গবেষণার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য জোগানো; উন্নত ফসলের জাত, লাগসই প্রযুক্তি এবং আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন ও প্রসার ঘটানো; উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অন্যান্য শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং কৃষি সম্প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কৃষি শিক্ষা, বিশেষত দেশের উচ্চতর কৃষি শিক্ষা বিভিন্ন সময়ে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। দেশে কৃষি শিক্ষার প্রথম ও মজবুত বুনিয়াদ গড়ে ওঠে ১৯৩৮ সালে তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক কর্তৃক ঢাকার মণিপুর ফার্মে (বর্তমানে শেরেবাংলা নগর) বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। রয়েল এগ্রিকালচারাল কমিশনের পরামর্শক্রমে প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউট ছিল তৎকালে প্রদেশে উচ্চতর কৃষি শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে উচ্চতর কৃষি শিক্ষার বৃহৎ বিদ্যাপীঠ ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যা ১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ‘‌পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৬১’-এর আলোকে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালে বিএসসি, এজি ডিগ্রি দানের লক্ষ্যে গাজীপুরের সালনায় বাংলাদেশ কৃষি বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কয়েকবার পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে কৃষির বিভিন্ন শাখায় এমএসসি, এজি এবং পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার জন্য এটির নতুন নামকরণ হয় স্নাতকোত্তর কৃষি শিক্ষা ইনস্টিটিউট (ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার—ইফসা)। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে একে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে পটুয়াখালীর দুমকীতে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ এবং ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেগুলো পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত করা হয় এবং কৃষিসংশ্লিষ্ট ডিগ্রিগুলোকে অনুষদভুক্ত করা হয়। রাজশাহীর নারিকেলবাড়িয়ায় প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কৃষি কলেজকে পরবর্তী সময়ে রাজশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কৃষি শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের চলমান খাদ্য সংকটের আজকের বাস্তবতায় উচ্চতর কৃষি শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আগামীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে এখনই এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্বারোপ করার কোনো বিকল্প নেই।

কৃষিকে একটি উড়ন্ত পাখি কল্পনা করলে পাখিটির মাথাকে কৃষি শিক্ষা এবং ডানা দুটিকে যথাক্রমে কৃষি গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারণের সঙ্গে তুলনা করা চলে। পাখিটিকে সুষমভাবে ওড়ার জন্য মাথার সঙ্গে ডানাদ্বয়ের সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। তেমনি কোনো দেশের কৃষির সুষম উন্নয়নের জন্য উচ্চতর কৃষি শিক্ষার সঙ্গে কৃষি গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারণের সমন্বয় অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত। অন্যদিকে উচ্চতর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত। আমাদের দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়াও বেশ ক’টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর প্রায় চার হাজার কৃষি গ্র্যাজুয়েট বের হয়। এদের মধ্য থেকে যোগ্যতম কৃষিবিদরা পরবর্তী সময়ে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি ফসলের জাত উন্নয়ন এবং কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আর তাদের এ সাফল্যকে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে ছড়িয়ে দেয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ মাঠে বিরাজমান কৃষকদের নানাবিধ সমস্যাসংশ্লিষ্ট গবেষণা কেন্দ্রে প্রেরণ করে। গবেষণা কেন্দ্রগুলো সমস্যার সমাধান করে তা পুনরায় সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়। কৃষি গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ উভয়ই কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি সার্বক্ষণিক সমন্বয় বিরাজ করে। কিন্তু এ উভয় প্রতিষ্ঠানের থেকে তথ্য প্রাপ্তি ও নানাবিধ সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উচ্চতর কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে অনেকটা অবাঞ্ছিত। ফলে উচ্চতর কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে যেমন মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে অন্ধকারে থাকছে, তেমনি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট তথ্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা প্রায়োগিক, বাস্তবধর্মী এবং সাম্প্রতিক তথ্য না পাওয়ায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থার ওপর। যদিও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে বাউরেস ও সাউরেসের মাধ্যমে তাদের গবেষণা কার্যক্রম এবং বহিরাঙ্গন বিভাগের মাধ্যমে তাদের সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু তাদের এ কার্যক্রম কোনোভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অন্যদিকে যেকোনো টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় উচ্চতর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা করে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না।

যোগ্যতম মানবসম্পদ গড়ার জন্য গুণগত উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কৃষি শিক্ষাকে আরো বেশি বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী করার জন্য এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। আর এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন কৃষি শিক্ষার সঙ্গে গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের কার্যকর সমন্বয় সাধন। এছাড়া বর্তমানে কৃষিতে স্নাতক পর্যায়ে আট সেমিস্টার এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিন সেমিস্টার মেয়াদি কোর্স পড়ানো হয়। কৃষি শিক্ষার বর্তমান স্নাতক পর্যায়ের কারিকুলাম ও সিলেবাস বেশ পুরনো ও ব্যাপক। প্রায়োগিক বিবেচনায় প্রয়োজন অনুসারে প্রচলিত কারিকুলাম সংশোধন করে সিলেবাসকে আরো বেশি সুনির্দিষ্ট করা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে সব পুরনো অচল বিষয় বাদ দিয়ে আগামী দিনের স্মার্ট কৃষির আধুনিক বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। দক্ষ কৃষিবিদ তৈরিতে ডিপ্লোমা পর্যায়ে এবং উচ্চতর কৃষি শিক্ষায় ৫০ ভাগ থিউরি এবং ৫০ ভাগ ব্যবহারিক এভাবে কোর্সগুলো পুনর্বিন্যাস করা দরকার। অনেক সময় লক্ষ করা যায়, স্নাতক পর্যায়ে কৃষির শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয় পড়লেও মাঠে গিয়ে কোনো বিষয়েই দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন না। তাই স্নাতক পর্যায়ে প্রথম চারটি সেমিস্টার সাধারণ বিষয়গুলো পড়িয়ে পরবর্তী তিন সেমিস্টার কোনো একটি বিষয়ে তাকে দক্ষ করে তোলা যেতে পরে এবং শেষ সেমিস্টার ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তার প্রাপ্ত শিক্ষা মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে পারে। সাধারণত যেকোনো কারিগরি শিক্ষায় স্নাতক পর্যায়ে ইন্টার্নশিপের বিধান রয়েছে। বর্তমানে কৃষিতে শুধু ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদে এটি চালু রয়েছে। কিন্তু এটি সব অনুষদেই চালু করা অপরিহার্য। তাই কৃষি শিক্ষাকে আরো বেশি প্রয়োগমুখী করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে এক সেমিস্টার ইন্টার্নশিপ চালু করা উচিত। এই ইন্টার্ন কোর্স কৃষি শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি ক্ষুধামুক্তির সংগ্রামে চলমান কৃষি আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে কৃষির নতুন নতুন কোর্স ও ডিগ্রি সমন্বয় করা প্রয়োজন। এছাড়া থাইল্যান্ডের মতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেশের সকল প্রকার কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মাঠ পর্যায়ের কৃষক এবং কৃষি উপকরণ সরবারহকারী ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা জরুরি। কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে এ সংযোগ স্থাপন করতে হবে। বাংলায় উচ্চতর কৃষি শিক্ষার বই অপ্রতুল। এজন্য বাংলায় উচ্চতর কৃষি শিক্ষার বই রচনা করা দরকার। উচ্চতর কৃষি শিক্ষার সংস্কারের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমলে নেয়া দরকার, তা হলো শিক্ষার্থীদের ধরন। বর্তমানে উচ্চতর কৃষি শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শহুরে শিক্ষার্থীদের একক আধিপত্য লক্ষ করা যাচ্ছে। শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এসব শিক্ষার্থীর দেশের প্রচলিত কৃষির কোনো মৌলিক ধারণা নেই। ফলে তারা লেকচার শিট পড়ে খুব ভালো রেজাল্ট করলেও বাস্তব কৃষির সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ গড়ে ওঠে না। এ প্রেক্ষাপটে দেশের উচ্চতর কৃষি শিক্ষায় গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা দরকার। গ্রামের সঙ্গে শহরের সংযোগ এবং গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া ব্যবহারিক কোর্স বাড়িয়ে এবং ইন্টার্নশিপ চালুর মাধ্যমে এ শূন্যতা পূরণ করা যায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিগ্রি, সিলেবাস, কারিকুলাম, শিক্ষার ধরন ও মূল্যায়ন পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন সারা বিশ্বে দৃশ্যমান। উচ্চতর কৃষি শিক্ষায় ব্যবহারিক খাতা লেখা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। তারা এটিকে সময়ের অপচয় হিসেবেই বিবেচনা করে। শিক্ষণ প্রক্রিয়ার এ প্রাচীন পদ্ধতিটির সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ব্যবহারিক খাতা না লিখিয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া যেতে পারে। বর্তমান কারিকুলামে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যেখানে একজন শিক্ষার্থী চার বছরে কোনো একটি ফসল ফলানোর জন্য জমি তৈরি হতে ফসল সংগ্রহ নিজে নিজে করতে পারে। কৃষি শিক্ষায় এ অনুধাবন অপরিহার্য। প্রথম বর্ষেই শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে এ ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া যেতে পারে, যেখানে সে একটি ফসল উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কার্যক্রম নিজ হাতে করবে। এতে কৃষির সঙ্গে তার একটি সংযোগ তৈরি হবে ও শিক্ষণ কার্যকর হবে। কৃষি শিক্ষায় স্নাতক পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের কোনো একজন শিক্ষকের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে, যিনি চার বছর শিক্ষার্থীকে গাইড করবেন। যিনি তাকে দিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা ও সম্পন্ন করবেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্টগুলো সম্পন্ন করা, ইন্টার্নশিপ করা, রিপোর্ট প্রস্তুতকরণ এবং থিসিস লেখার ক্ষেত্রে ওই গাইড সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন।

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের মাটি ও মানুষ। আর কৃষিই হলো আমাদের জীবন ও জীবিকা। কৃষিকে নিয়েই বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হবে। তাই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। সেজন্য দেশের কৃষিশিক্ষাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো জরুরি। কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণসহ দেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থার নেতৃত্বে রয়েছেন যে কৃষিবিদরা তারা যদি আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যোগ্য হিসেবে গড়ে না ওঠেন তাহলে কৃষি নিয়ে আমাদের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট কৃষিবিদ তৈরিতে স্মার্ট কৃষিশিক্ষার বিকল্প নেই।

আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ: চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন