বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে সমাবর্তন মানে উচ্ছ্বাস ঘেরা এক অনুষ্ঠান, যার আড়ালে বাজতে থাকে বিদায়ের করুণ সুর। সম্প্রতি এ অনুভূতির মধ্য দিয়ে গেলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করা শিক্ষার্থীরা। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ষষ্ঠবারের মতো সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়েছিল। সমাবর্তন অনুষ্ঠান ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি, কিন্তু এর কয়েকদিন আগে থেকেই চলছিল আনন্দ উৎসব।
শিক্ষার্থীরা তাদের মা-বাবা, অগ্রজদের ক্যাম্পাসে নিয়ে এসে নিজ নিজ ভঙ্গিতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কেউ আনন্দ উদযাপনে নিয়ে এসেছেন পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যকে। তেমনই অনেক শিশুর মধ্যে আট মাস বয়সের ফুটফুটে আয়িশা ইসলামকে চোখে পড়ল। সে অনুষ্ঠানের একদিন আগে মা শারমিন আক্তার ও বাবা আনিসুল ইসলামের ক্যাম্পাস দেখতে এসেছে। আনিস ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এবং মা শারমিন ২০১৯ সালে ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। আনিসের চাকরি সূত্রে বর্তমানে তারা চুয়াডাঙ্গায় থাকেন। এতদিনে তাদের আর ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ হয়নি। কিন্তু সমাবর্তন বলে কথা। পৃথিবীর সব কাজ তোলা থাক, ক্যাম্পাসের ডাহুক আর জলপিপির লেকের ধারে যাওয়া চাইই চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, সান্ধ্যাকালীন স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া ১৫ হাজার ২১৯ জন এবারের সমাবর্তনের জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ১১ হাজার ৪৪৪ জন ও উইকেন্ড প্রোগ্রামের ৩ হাজার ৪৬১ জন, এমফিল ডিগ্রির ৩৪ জন ও পিএইচডি সম্পন্নকারী ২৮০ জন রয়েছেন। তবে সমাবর্তনে নিয়মিত স্নাতক সম্পন্নকারী ১২ হাজার ৪৬৮ জন, স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ১০ হাজার ৩৭১ জন, সান্ধকালীন কোর্সের ৮ হাজার ৭৫ জন ও এমফিল-পিএইচডি সম্পন্নকারী ৮০২ জনসহ মোট ৩১ হাজার ৭১৬ জন গ্র্যাজুয়েটের এক মিলনমেলা।
সমাবর্তন নামক শিক্ষাজীবনের এ মাইলফলককে স্মরণীয় করে রাখতে গ্র্যাজুয়েট অনেকে মা-বাবাকে ক্যাম্পাসে গাউন-টুপি পরিয়ে কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে দিয়েছেন। তবে মো. তৌফিক আল ইমরানের গল্পটা অন্য রকম। ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য পরের বছর পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাজ্যে। ইচ্ছা ছিল মা-বাবা, ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সমাবর্তনে অংশ নেয়ার। কিন্তু পৃথিবীর দূরত্ব তার ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলে গাউন-টুপি পরা মা-বাবার হাসিমুখ দেখার এক যুগের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে! হয়তো তা-ই হতো, কিন্তু সবুজের এ ক্যাম্পাসের সহপাঠীরাও পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠেন। তৌফিকের বন্ধু আরিফ, ফরহাদ, পরশমনি, মামুন ও ওয়াসি মিলে তৌফিকের মা-বাবাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছেন। তৌফিক যেভাবে মা-বাবার হাতে গাউন-টুপি সমর্পণ করতেন সেভাবে তা করেছেন বন্ধুরা। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা তৌফিক ভার্চুয়ালি এ দৃশ্য দেখে হয়েছেন আবেগাপ্লুত।
স্বল্প সময়ের ঘোষণায় সমাবর্তন আয়োজন নিয়ে প্রবাসী ও চাকরিজীবীদের আক্ষেপ ছিল। যেহেতু দীর্ঘদিন পর সমাবর্তন হচ্ছে সেহেতু অনেক গ্র্যাজুয়েট জীবিকার তাগিদে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাদের অভিযোগ ছিল, যদি ছয় মাস আগ থেকে এ আয়োজনের ঘোষণা আসত তবে ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে এসে সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতেন। তবে ভাগ্যের জোরে তড়িঘড়ির আয়োজন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে মো. রাশেদুর রহমান রাশিব ও ফৌজিয়া আহমেদ রিনি দম্পতির। দুজনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তারা ২০২১ সাল থেকে কানাডায় রয়েছেন। ছুটিতে দেশে আসার জন্য পয়লা জানুয়ারি টিকিট বুক দেন, দেশে আসবেন ফেব্রুয়ারিতে। এর পরেই জানতে পারেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের বিষয়ে। দেশে আসার সংক্ষিপ্ত এ সফরে এত বড় ইভেন্ট পেয়ে যাবেন, যা তারা ভাবতেও পারেননি। নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন। অবশ্য তাদের মতো আরো অনেকেই এসেছেন ভারত, জার্মানি, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও এ রকম হাজারো শিক্ষার্থী এসেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নিতে।
জাবি থেকে ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন প্রদীপ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে সমাবর্তন পাওয়া আসলেই খুব আনন্দের। কেননা এ সমাবর্তনে আমি ও আমার শিক্ষার্থীরা একই সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছি। সমাবর্তনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। সমাবর্তন আয়োজন করা কষ্টসাধ্য কাজ। তবু প্রতি বছর সমাবর্তন আয়োজন করলে অনেকে বেশি ভালো হবে।’
সমাবর্তন অনুষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছে যে কতটা আকাঙ্ক্ষিত তা ডেঙ্গু ও জন্ডিস আক্রান্ত অনিন্দিতা হাবিবের ছুটে আসা প্রমাণ দেয়। অনিন্দিতা কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। তার কাছে সমাবর্তন মানে গাউন পরা শিক্ষার্থীর এক হাতে কষ্টার্জিত সনদ আর অন্য হাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সমাবর্তনের ব্যাগ। তিনি বলেন, ‘পঞ্চম সমাবর্তনে চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে জাবিকে নিজ হাতে সাজানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে নিজে সমাবর্তনে অংশ নেয়ার আনন্দ আর অদ্ভুত অনুভূতি এ ষষ্ঠ সমাবর্তন বলে দিয়ে গেল। যখন শুনলাম ফেব্রুয়ারিতে সমাবর্তন তখন কেবল চাকরি পেয়েছি। তখন থেকে একবারও ছুটি নিইনি। কারণ সমাবর্তনের সময় ছুটি লাগবে। তবে দুঃখজনকভাবে হঠাৎ ডেঙ্গু ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। ফেসবুকজুড়ে সবার সমাবর্তন নিয়ে মাতামাতি, আনন্দ করা দেখে আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলাম না। মনকে বললাম, হয়তো সবার মতো উল্লাস করতে পারব না কিন্তু তাতে কী! এরপর মা-বাবাকে রাজি করিয়ে সৈয়দপুর থেকে আকাশপথে রওনা হয়ে ক্যাম্পাসে যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে ১২টা পার হয়ে গেছে। এ অবস্থায় শরীর যেন আর চলেই না। টেনেটুনে বটতলায় যেতেই প্রিয় চেনা মুখগুলো দেখে যেন সত্যিই সুস্থ হয়ে গেলাম।’
প্রাক্তন হওয়ার পর একসঙ্গে সব চেনা মুখগুলোকে একটা দিনই দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মাঝে এমন মুখও হয়তো আছে যার সঙ্গে আর কখনো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ বিশেষত্বই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকে সবার অবচেতনমনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তাই তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আবাসিক পাখিরা ছুটে এসেছিল অতিথি হয়ে।