বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বছর আটেক আগে ৩ বিলিয়ন ডলারের বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন রিলায়েন্স এডিএ গ্রুপের কর্ণধার অনিল ধীরুভাই আম্বানি। যদিও শেষ পর্যন্ত তার প্রস্তাবিত এসব বিনিয়োগের বেশির ভাগই আর আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে রিলায়েন্সের একমাত্র প্রকল্প হিসেবে টিকে আছে মেঘনাঘাটে নির্মাণাধীন ৭১৮ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। যদিও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের জায়ান্ট ‘জাপান এনার্জি ফর নিউ এরা’র (জেরা) কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে রিলায়েন্স। বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ারও এখন জেরার কাছে বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ থেকে রিলায়েন্স তার ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে কি?
বাংলাদেশে রিলায়েন্স পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘রিলায়েন্স বাংলাদেশ এলএনজি অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেডের’ অধীনে। কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে শুধু কোম্পানিটির নামের সঙ্গে রিলায়েন্স যুক্ত রয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত রিলায়েন্স এ প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা ছিল। কিন্তু জেরার কাছে ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রির পর থেকেই রিলায়েন্স আর এ প্রকল্পের নেতৃত্বে নেই। অর্থায়ন জোগাড় করা থেকে শুরু করে কেন্দ্র নির্মাণ পর্যন্ত সবকিছুই জেরার তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। রিলায়েন্স এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অংশীদারের ভূমিকায় রয়েছে। কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে এলে রিলায়েন্সের হাতে থাকা ৫১ শতাংশ শেয়ার জেরার কাছে বিক্রি করে দিয়ে এ প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান কোম্পানিটির কর্মকর্তারা। রিলায়েন্সের কর্মীরা আরো জানান, তারা একসময় প্রতিষ্ঠানটির অধীনে থাকলেও ২০১৯ সালের পর থেকে তারা জেরার অধীনে কাজ করছেন। এ অবস্থায় কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর হাতে থাকা ৫১ শতাংশ শেয়ার জেরার কাছে বিক্রি করে দিয়ে এ প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে রিলায়েন্স।
বিদ্যুৎ প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রঞ্জন লোহারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর ছয় বছরের আগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে না। তবে ছয় বছর পর বিক্রির ক্ষেত্রেও মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের কাছে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার বিষয়টিই মুখ্য। সরকার চাইলে চুক্তির শর্ত শিথিল করে পুরো শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরের অনুমোদন দিতে পারে। ২০১৯ সালে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েই জেরার কাছে ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছিল রিলায়েন্স। তবে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু না হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। তাই এখনই রিলায়েন্সের পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক কোনো আবেদন করা হয়নি।
বিষয়টি জানতে চাইলে বিপিডিবির সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) মো. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, মালিকানা বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের বিষয়ে রিলায়েন্সের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সম্পৃক্ত হতে ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দেয় রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড। এতে তিন হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়। এসব প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম পর্যায়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন পায় কোম্পানিটি। শুরুতেই ৭১৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের অনুমোদন পায় রিলায়েন্স। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে জমি ইজারা ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করে রিলায়েন্স পাওয়ার। তিতাস গ্যাসের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তিও করে কোম্পানিটি।
তবে ২০১৬ সালে ভারতে রিলায়েন্স গ্রুপের বিভিন্ন ব্যবসায় সূচক ব্যাপক হারে নিম্নমুখী হতে শুরু করলে একপর্যায়ে বিপুল পরিমাণ ঋণে জড়িয়ে পড়েন অনিল আম্বানি। সেই সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থার ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দিয়ে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে চান তিনি। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চলমান অবস্থায় জেরার কাছে ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে রিলায়েন্স পাওয়ার। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শেয়ার বিক্রি করে বড় অংকের ঋণ পরিশোধ করেন অনিল আম্বানি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অনিল আম্বানির জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ। কারণ এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ সরঞ্জাম বিক্রি করে দেড় হাজার কোটি রুপির ঋণ পরিশোধ করেন তিনি। ২০১৯ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে রিলায়েন্স সামালকোট বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটসের (ইউএস এক্সিম ব্যাংক) সঙ্গে ২ হাজার ৫০০ কোটি রুপির ঋণ চুক্তি করেছিল রিলায়েন্স পাওয়ার। এ প্রকল্পের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ সরঞ্জামের তিনটি মডিউল আমদানি করে রিলায়েন্স পাওয়ার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি না হওয়ায় তিনটি মডিউলের একটি বাংলাদেশের মেঘনাঘাটের বিদ্যুৎ প্রকল্পে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইপিসি ঠিকাদারের দায়িত্ব পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনের কাছে মডিউলটি ১ হাজার ৫০০ কোটি রুপিতে বিক্রি করে রিলায়েন্স পাওয়ার। এর মাধ্যমে ইউএস এক্সিম ব্যাংকের দেড় হাজার কোটি রুপির ঋণ পরিশোধ করে রিলায়েন্স পাওয়ার।
রিলায়েন্সের মেঘনাঘাট ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি), মিজোহো ব্যাংক, সুমিতমো মিতসুই ব্যাংকিং করপোরেশন, এমইউএফজি ব্যাংক ও সোসাইতে জেনারেলে। সব মিলিয়ে উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আসবে ৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। মূলত জেরা যুক্ত হওয়ার কারণে এ প্রকল্পে জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ প্রদানে এগিয়ে আসে। জাপানের রাষ্ট্রায়ত্ত নিপ্পন এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন্স্যুরেন্স এ বিদ্যুৎ প্রকল্পে বেসরকারি খাতের ঋণ ও জেরার অংশীদারত্বের নিরাপত্তা দেবে।
দেশের বৃহৎ শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে ১ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার তিনটি বৃহৎ এলএনজি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে রিলায়েন্সের ৭১৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি। ২০২২ সালের আগস্টে কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সরজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং জেরার কর্মকর্তা ও কর্মীরা কেন্দ্রটির নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। মূল উদ্যোক্তা রিলায়েন্স হলেও কেন্দ্রটির ইপিসি ঠিকাদার দক্ষিণ কোরিয়ার ‘স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনে’র কর্মকর্তারা কেন্দ্রটি নির্মাণের কার্যক্রম তদারকি করছেন। সেখানে থাকা কর্মীরা জানান, বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৭০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের শুরুর দিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবে বলে আশা করছেন তারা।
বর্তমানে প্রকল্পটির অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির প্রাইভেট জেনারেশন (আইপিপি/পিপিপি) সেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) এবিএম জিয়াউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা চাইছি দ্রুতই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসুক। বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির গ্যাস সংযোগ অবকাঠামোর কার্যক্রম চলছে। এটি সম্পন্ন হলে তখন কেন্দ্রটি চালুর সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।’
মেঘনাঘাটে একই এলাকায় ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরো একটি এলএনজি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে ইউনিক গ্রুপ এবং ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিচালনা করছে দেশীয় বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলতি বছরের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। যদিও এসব কেন্দ্রে কীভাবে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হবে এবং কোথা থেকে এ গ্যাস আসবে সেই বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলছে না বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো।
পিতা ধীরুভাই আম্বানি মারা যাওয়ার পর মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানির দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এরপর ২০০৫ সালে রিলায়েন্সের সম্পদ ভাগাভাগি হয়ে যায়। অনিল আম্বানির ভাগে পড়ে টেলিকম, অবকাঠামো ও আর্থিক সেবা খাতের ব্যবসার দায়িত্ব। বাবার মতো অনিলও ব্যাংকের অর্থায়নে মেগা প্রকল্প স্থাপনের বিষয়ে বেশ উচ্চাভিলাষী ছিলেন। ভারতজুড়ে সড়ক প্রকল্প, মেট্রো রেল ও কয়লাভিত্তিক বড় আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বেশ তড়িঘড়ি শুরু করেন তিনি। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থার কাছ থেকে বিপুল অংকের ঋণ নেন তিনি। তবে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস (আরকম) প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ব্যবসায় পতন শুরু হলে একের পর এক ঋণের জালে জড়িয়ে যেতে থাকেন অনিল। ২০১৯ সালে অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে ভারতে ঋণের অর্থ ফেরত না দেয়ার গুরুতর অভিযোগ ওঠে। ঋণের চাপে জর্জরিত অনিল আম্বানি ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (সেবি) নির্দেশনার কারণে রিলায়েন্স পাওয়ারের পর্ষদের পদ ছাড়তেও বাধ্য হয়েছেন। সর্বশেষ এ বছরের জানুয়ারিতে আরকমের দুই সাবসিডিয়ারি রিলায়েন্স রিয়েলটি লিমিটেড (আরআরএল) ও ক্যাম্পিয়ন প্রপার্টিজ লিমিটেডের (সিপিএল) সম্পত্তি বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি আরকমের মূল কার্যালয় ধীরুভাই আম্বানি নলেজ সিটি (ডিএকেসি) বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।