ডলার সংকটের কারণে গত মাসে আমদানীকৃত কয়লার মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে জটিলতায় পড়ে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। সর্বশেষ ডলার সংকটে জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করতে না পেরে আমদানীকৃত কয়লা খালাস নিয়ে জটিলতায় পড়ে বিসিপিসিএল।
শুধু পায়রায় চালু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কয়লা আমদানি করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। এর মধ্যে আবার নির্মাণাধীন ও উৎপাদনের অপেক্ষায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে সাত হাজার মেগাওয়াটে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, সারা বছর এ সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে কয়লা প্রয়োজন সাড়ে ২৫ মিলিয়ন টন। গড় মূল্য টনপ্রতি ২০০ ডলার হিসাব করলেও আগামী দুই বছরে চালু হতে যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য শুধু কয়লা আমদানি করতেই প্রয়োজন পড়বে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে চলমান অস্থিতিশীলতা প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর বিপরীতে চলমান ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা না গেলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে মারাত্মক বিপত্তির মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানি নিয়ে সাম্প্রতিক বিড়ম্বনাগুলোকে এরই ইঙ্গিতবাহী হিসেবে দেখছেন তারা।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন নিয়ে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ’ (এফইআরবি) আয়োজিত ‘এনার্জি ট্রানজিশন: গ্লোবাল কনটেক্সট অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক সেমিনারে উপস্থাপিত এক প্রবন্ধেও ঠিক একই পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়, আগামী দুই বছরে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার্য কয়লা আমদানিতে বার্ষিক ব্যয় দাঁড়াতে যাচ্ছে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলারে।
দেশে চলমান নির্মাণাধীন ও উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় থাকা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি ব্যয় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, ১ হাজার মেগাওয়াট একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক কয়লার প্রয়োজন পড়ে ১০ টন। সে হিসাবে সারা বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে কয়লার প্রয়োজন পড়বে ২৫ মিলিয়ন (আড়াই কোটি) টনের বেশি। প্রতি টন কয়লার দাম গড়ে ২০০ ডলার হিসাব করলে দুই বছর পর বার্ষিক কয়লা আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ কোটি ডলারের বেশিতে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ডলার ও রিজার্ভ সংকটের কারণে এখন গ্যাস ও কয়লা আমদানিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। আগামীতে কয়লাভিত্তিক এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে গেলে জ্বালানি আমদানি অনিশ্চয়তায় পড়বে, যেটি এখন হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে না। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে, ভোক্তার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এভাবে জ্বালানি পরিকল্পনা করা যায় না।
ডলার ও অর্থ সংকটে গত বছরের আগস্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। ওই সময় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। বিদ্যুৎ বিভাগ ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে বিদ্যুতের সংকট কমে যাবে। একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপরও চাপ কমে আসবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে এলএনজি আমদানির চেয়ে কয়লা আমদানি ব্যয় তুলনামূলক কম। তবে তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ কয়লা আমদানির জোগান নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে এসব কয়লা আমদানির জন্য যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন, সেগুলো গড়ে তোলা যাচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্যানুযায়ী, উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে দু-একটিতে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাকিগুলোও আগামী দুই বছরের মধ্যেই উৎপাদনে আসতে পারবে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের জন্য মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের। বাংলাদেশ ও ভারতের সমান অংশীদারত্বে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের এরই মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে গত বছরের ১৫ আগস্ট এবং ২৫ নভেম্বর দুই দফায় পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। তবে কবে নাগাদ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে জানা যায়নি বিপিডিবিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। পাওয়ার সেলের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটই আগামী জুনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করতে পারবে।
পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন চালু হয়েছে। সেখানে এখন একই সক্ষমতার আরো দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এর মধ্যে একটি নির্মাণ করছে বিসিপিসিএল। আরেকটি করছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও চীনা প্রতিষ্ঠান নরিনকো।
বেসরকারি একটি কোম্পানি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণ করছে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া বরিশালে ৩০৭ মেগাওয়াট ও ঢাকায় ৬৩৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরো দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এর সবক’টিই আগামী দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসতে পারে।
দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে এবং এ বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের পরিকল্পনা হলো কম মূল্যের জ্বালানি ব্যয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে উচ্চমূল্যের জ্বালানি তেল ও স্পট এলএনজি আমদানি কমানো হয়েছে। আগামীতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আসবে, সেগুলোর জ্বালানি জোগান ও কীভাবে কম মূল্যে পাওয়া যায়; সেই চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে আমরা বরাবরই ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানিতে প্রাধান্য দিচ্ছি। কারণ দেশটি থেকে আমদানীকৃত কয়লার মান ও পরিবহন খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম। এছাড়া বিকল্প আমদানিকারক হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে আমাদের তালিকায় রেখেছি।’