দেশের উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির বিষয়গুলো ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বছরপ্রতি এসব বিষয়ে শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ বৃদ্ধির হার চোখে পড়ার মতো। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিষয় পছন্দের তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বা সিএসই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের ইউনিটগুলোয় যারা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের পছন্দের শীর্ষে থাকছে সিএসই বা এর কাছাকাছি বিষয়গুলো। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে সিএসই ট্রেন্ডের এ চিত্র আরো অনেক বেশি স্পষ্ট। কিছু বেসরকারি উচ্চ শিক্ষালয়ে তো সিএইস শিক্ষার্থী বাকি সব বিভাগ বা প্রোগ্রামের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যারও বেশি।
কম্পিউটার বিজ্ঞানে এত আগ্রহ কেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, পড়ার বিষয় পছন্দের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাকরির বাজারের বিষয়টি মাথায় রাখেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চাকরির বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের বেশ চাহিদা তৈরি হয়েছে। আগামীর কর্মবাজারেও তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের চাহিদা আরো বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে সমসাময়িক সময়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। এসব প্রেক্ষাপটকেই সিএসই ক্রেজের প্রভাবক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অধ্যাপক ড. মো. মামুনুর রশিদের ভাষ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয় পছন্দের তালিকা পূরণ করে। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পছন্দের এ তালিকার শীর্ষে জায়গা পাচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞান বা এর কাছাকাছি বিষয়গুলো। এক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার বিষয়টি প্রভাবকের ভূমিকায় রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও একই ধরনের ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে।
দেশে তথ্য-প্রযুক্তির জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আগের তুলনায় এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় এ নিয়ে ভালোই আলোচনা হয়। চাকরিতে ভালো বেতন, গুগল-মাইক্রোসফটে কাজের সুযোগসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও কাজের ভালো সুযোগের কারণেও অনেকেরই এ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। ট্রেন্ডের কারণে আজকাল দেশের প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটি রয়েছে। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং—সবগুলোরই মোটামুটি সিলেবাস কাছাকাছি। পড়তে চাইলে পছন্দ ও সুযোগের অভাব হবে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও ল্যাবের সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে একটু জেনে নেয়া ভালো।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবগুলোয়ই সিএসই বিষয়ে পড়ানো হয়। এছাড়া সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই সিএসই বিভাগ রয়েছে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তো সিএসই নেই—এমন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়াই কঠিন। তবে সিএসই পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় সামনের দিকে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নর্থ সাউথ, ইউআইইউ, ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, আইইউবি, আহসান উল্লাহ, এআইইউবি ও ড্যাফোডিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিএসই পড়ার ক্ষেত্রে ২-৩ থেকে ১০-১২ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে বোর্ড অব অ্যাক্রেডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশন (বিএইটিই) স্বীকৃত প্রোগ্রামগুলোকে মানের দিক থেকে এগিয়ে রাখছেন সিএসই সংশ্লিষ্টরা।
চাকরির দিক থেকে দেখলে অনেক ভালো চাকরিই রয়েছে, আবার এ বিষয়ে পড়েই অনেকে বসেও থাকে। বসে থাকার কারণ হিসেবে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবকে দায়ী করা যায়। এত গ্র্যাজুয়েটের মাঝে কোম্পানি চাইবে সেরাকে নিতে। গড়ে হাজারেরও বেশি আবেদন পড়ে একটি চাকরির জন্য। সদ্য গ্র্যাজুয়েটরা চায় কাজ শেখার একটি সুযোগ। কিন্তু সেটি দেয়া বেশির ভাগ কোম্পানির পক্ষে সেভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্য নিজেরই তৈরি করে নিতে হবে নিজেকে।
আর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কম্পিউটার শিক্ষাসংক্রান্ত মূল বইগুলো ভালোভাবে বুঝে পড়লে, সেটি স্নাতকের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘সি প্রোগ্রামিং’ অধ্যায়ে অনেক বেসিক প্রোগ্রাম রয়েছে। সেগুলো বাদ দিয়ে আসলে হবে না। যদি সমস্যাগুলো সমাধান করতে অনেক সময় লেগে যায়, তাহলে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। মনে রাখতে হবে, এটি দক্ষতার জায়গা। ভার্সিটির জুনিয়রও আপনার চেয়ে কোনো প্রোগ্রাম দ্রুত সমাধান করতে পারার ক্ষমতা রাখে। কোডিং কনটেস্টে অংশগ্রহণ করতে হবে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এর চেয়ে আর ভালো উপায় নেই। এছাড়া বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘এইচটিএমএল’ থাকার ফলে বেসিক ওয়েবের ধারণাটা প্রায় সবারই রয়েছে। তবে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের প্রধান তিনটি বিষয় হচ্ছে—এইচটিএমএল, সিএসএস ও জাভাস্ক্রিপ্ট। বাকি দুটি বিষয়ে যদি পারদর্শী হয়ে ওঠা যায়, তাহলে এটি ভবিষ্যতে প্রচুর কাজে দেবে। আজকাল ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ছাড়া গতি নেই। পাশাপাশি ডাটাবেজ ল্যাঙ্গুয়েজ এসকিউএল জেনে রাখা উত্তম। দক্ষতা যত বাড়বে, চাকরির ক্ষেত্রে সম্ভবনা তত জোরালো হবে। এছাড়া সিএসই পড়তে হলে প্রোগ্রামিং ভালো লাগতে হবে, গণিত ভালো জানতে হবে—এসব সবাই বলে। তবে সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ভালোবাসতে হবে।