ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি

পদ্মা রেল প্রকল্প এখন আরো ব্যয়বহুল

শামীম রাহমান

যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। প্রকল্পের নির্ধারিত ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার সিংহভাগই এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের পরিমাণ ২৬৭ কোটি ডলার। এজন্য স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তিতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ৭৮ টাকা ৮৫ পয়সা করে। যদিও বর্তমানে বিনিময় হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ টাকা পয়সায়। সে হিসাবে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে বকেয়া বিল বাবদ ঠিকাদারকে আরো প্রায় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয় নিয়ে নানা শঙ্কার কথা বলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার কমতে থাকায় তাদের আশঙ্কা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে।

২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৬৭ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির মূল্যমান ছিল তখনকার হিসাবে প্রায় ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশী মুদ্রায় এর মূল্যমান দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকায়।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১৮৯ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। টাকার অবনমন হওয়ায় ঠিকাদারকে বকেয়া বিল বাবদ সংস্থাটির ব্যয় আরো বাড়ছে। বিষয়ও এখন রেলকর্তাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে শুধু পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প নয়, বিদেশী ঋণে বাস্তবায়ন করা সব প্রকল্পেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে স্থানীয় মুদ্রায় আয় করে। শুধু টাকার অবমূল্যায়নেই পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে ১১-১২ শতাংশ। তাই বলা যায়, আমাদের দায়ভার বেড়ে গেল। অবমূল্যায়নের ফলে বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়ে যাওয়ায় এখন যে বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে সেটি হলো প্রকল্পটির ইকোনমিক রিটার্ন বা আয় যাতে বেশি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করা। বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে ব্যয় আরো বৃদ্ধির শঙ্কা থেকে যায়।

টাকার অবমূল্যায়নের অভিঘাত কাটাতে বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পের আয় বৃদ্ধি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার ওপর জোর দিলেও বাস্তবে দুটি বিষয় নিয়েই আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকেন্দ্রিক কয়েকটি বড় প্রকল্প বাতিল হয়ে যাওয়ায় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আর্থিক মুনাফাযোগ্যতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক . মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের পর পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা রেলপথ আন্ডার ইউটিলাইজড থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ রেলপথটি খুব বেশি ব্যবহার নাও হতে পারে। তাই বলা যায়, খরচের বিবেচনায় রেলপথটির খুব বেশি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

অন্যদিকে পদ্মা রেলের কাজ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ৬১ দশমিক শতাংশ। আগামী ২২ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে যে পরিমাণ জনবল প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজন, বর্তমানে তার চেয়ে কমসংখ্যক জনবল প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত থাকার কথা জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

দ্রুত বাস্তবায়নের সুবিধার্থে পদ্মা রেল সংযোগের রেলপথ তৈরির কাজ তিন অংশে করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) প্রথম অংশে ঢাকা-মাওয়া, দ্বিতীয় অংশে মাওয়া-ভাঙ্গা শেষ অংশে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত কাজ চলমান। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে কর্মরত জনবল প্রয়োজনের তুলনায় কম। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, নির্মাণকাজের এই দুই অংশে দক্ষ চীনা জনবল স্থানীয় শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি পর্যাপ্তসংখ্যক কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তা নেই। নির্মাণকাজের শেষ অংশ ভাঙ্গা-যশোরে জনবলের খুব একটা সমস্যা না থাকলেও সংকট রয়েছে ব্যাচিং প্লান্ট (সিমেন্ট, বালু, কংক্রিটসহ বিভিন্ন উপাদান মেশানোর যন্ত্র) কংক্রিট ট্রাকের। আর পুরো প্রকল্পের কাজে বিকল্প যন্ত্রপাতি, উপকরণ যন্ত্রাংশের ঘাটতি রয়েছে, যেগুলোর অভাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-চীন যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের ১৫তম বৈঠকেও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজে নির্মাণযন্ত্র জনবল সংকটের বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে প্রকল্পটি সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়ের উত্থাপিত তথ্যে বলা হয়, নির্মাণযন্ত্র জনবল বৃদ্ধির জন্য ঠিকাদারকে বারবার তাগিদ দেয়া হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। দুয়ের ঘাটতির কারণে প্রকল্পটির অগ্রগতিও সন্তোষজনক হচ্ছে না।

প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে পুরো প্রকল্পে কর্মরত মোট জনবলের পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার। এর মধ্যে চীনের নাগরিক রয়েছেন ২০০ জনের মতো। প্রকৌশলী আছেন প্রায় ২০০ জন। ঠিকাদারের অধীনে কর্মরত শ্রমিকের স্থানীয় সংখ্যা চার হাজারের মতো। নিরাপত্তা কর্মকর্তার সংখ্যা ৬০। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদারকে আরো অন্তত তিন ইউনিট বা প্রায় ২০০ জন কর্মী বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রেলপথ তৈরির কাজে দুই ইউনিট এবং রেলপথের সিগন্যালিং কাজে আরো এক ইউনিট জনবলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ার কথা জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

প্রকল্প এলাকায় নির্মাণযন্ত্র-জনবল বাড়াতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসিকে বারবার তাগিদ দিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি রেলওয়ে। উল্টো নির্মাণযন্ত্র-জনবল বাড়াতে রেলওয়ের কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছে সিআরইসি। যদিও চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারকে এভাবে অতিরিক্ত অর্থ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সিআরইসিকে আমরা প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্মাণযন্ত্র রাখার অনুরোধ করেছি। কিন্তু এজন্য তারা অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছে। অর্থ পাওয়ার পর তারা প্রকল্প এলাকায় নির্মাণযন্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে এবং সে অনুযায়ী জনবল বাড়াবেএমন একটি প্রস্তাব সিআরইসি আমাদের দিয়েছে।

নির্মাণযন্ত্র-জনবল বৃদ্ধির জন্য ঠিকাদারের দাবীকৃত অর্থ রেলওয়ে দেবে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা বাড়তি টাকা চাইলেই তো আমরা তাদের সরাসরি তা দিতে পারি না। এর জন্য সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। তাদের প্রস্তাবটি আমরা যাচাই-বাছাই করছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন