অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পর আগে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে একটি ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হতো। এরপর শুরু করা হতো শিক্ষার্থী ভর্তিসহ অন্য সব শিক্ষা কার্যক্রম। যদিও কয়েক বছর ধরে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।

কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পর আগে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে একটি ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হতো। এরপর শুরু করা হতো শিক্ষার্থী ভর্তিসহ অন্য সব শিক্ষা কার্যক্রম। যদিও কয়েক বছর ধরে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনুমোদনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনুমোদন পাওয়ার পর কোনো ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি কোথাও কোথাও শিক্ষক নিয়োগের আগেই চলছে শিক্ষার্থী ভর্তি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমও চলছে অগোছালোভাবে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব অবকাঠামোয় ক্লাস শুরুর আগেই কয়েকটি ব্যাচ গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে বের হয়ে যাওয়ার নজিরও দেখা যাচ্ছে।

এমন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০১ সালে আইন পাস হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালে। রাঙ্গামাটি শহরের একটি বেসরকারি স্কুলের অবকাঠামো ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় অনেকটা অগোছালোভাবেই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিজেদের ক্যাম্পাসে কার্যক্রম স্থানান্তর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। সে হিসেবে ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকটি ব্যাচ গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে বের হয়ে গেছে।

যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করার আগে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর বিষয়টিকে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণকারীরাও। বিষয়ে  বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক . মুহাম্মদ আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। যদিও নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এটা অনুসৃত হচ্ছে না। এটা গুণগত উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিবন্ধক। তাই আমি মনে করি, বিষয়ে ভাববার সুযোগ রয়েছে।

ন্যূনতম অবকাঠামো শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া কমিশন থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন দেয়া হয় কেনএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন চাইলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন বন্ধ রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে একটি নীতিনির্ধারণ জরুরি। কেননা যদি এখন কোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে কমিশন থেকে অনুমোদন দেয়া না হয়, তাহলে তারা আগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদাহরণ টানবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি নীতি তৈরি করলে সবাই সেটা অনুসরণ করবে।

অপরিকল্পিত এসব বিশ্ববিদ্যালয় একপর্যায়ে নিজস্ব অবকাঠামোয় কার্যক্রম শুরু করলেও শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হলেও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো সুবিধা খুবই অপ্রতুল। উন্নয়ন কার্যক্রমে তেমন কোনো গতি নেই। একাডেমিক প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ধরনের আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার অঞ্জন কুমার চাকমা বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন উপাচার্য। এখন উপাচার্য না থাকায় কোনো প্রকল্প পরিচালকও নেই। এজন্যই উন্নয়ন কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত উপায়ে পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।

চাঁদপুর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায় গত বছর। অনুমোদনের এক বছরের মাথায় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখনো কোনো শিক্ষকই নিয়োগ দেয়া হয়নি। এমনকি কোনো ধরনের জনবল কাঠামোও চূড়ান্ত করতে পারেনি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক . মো. নাছিম আখতার বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার আমাকে নিয়োগ দিয়েছে, আমি তো বসে থাকতে পারি না। তাই শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়, সেখানে আমার কী করার আছে। আর আমাদের যেহেতু জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হচ্ছে, সেক্ষেত্রে অবকাঠামো নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হবে না। এছাড়া দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো একটি ভবন নিয়েই কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়াও চলমান।

একইভাবে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শেখ হাসিনা মেডিকেল ইউনিভার্সিটি খুলনাএই সব টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অপরিকল্পিত উপায়ে গড়ে উঠছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলোতেই উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম সুবিধা নিশ্চিত না করেই কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে কোনোটিতে অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে, কোনোটিতে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে, আবার কোনো কোনোটিতে অবকাঠামো শিক্ষকউভয় ক্ষেত্রেই বেশ ঘাটতি রয়েছে। এমনকি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যকেরই এখনো ক্যাম্পাসের জমি অধিগ্রহণই হয়নি। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ধরনের সংকট প্রকট।

ন্যূনতম পরিবেশ গড়ে তোলার আগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন দেয়া উচিত নয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক . আরেফিন সিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, পাবলিক হোক কিংবা প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অবকাঠামো তৈরির আগে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর কোনো সুযোগ নেই। গ্রন্থাগার ল্যাবরেটরির মতো মৌলিক সুবিধা ছাড়া উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কথা ভাবাও যায় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই কয়েকটা ব্যাচ গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। অথচ তারা উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম সুবিধাও পায়নি। উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ গড়ে তোলার আগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়া উচিত নয়। সরকারের উচিত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নীতি প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন করা।

আরও