ডিজিটাল যুগে ব্যাংকে বড় অংকের নগদ লেনদেন অস্বাভাবিক বেড়েছে

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন হয়েছিল ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১-এ তা ১৪ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

হাছান আদনান

দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সেবা। পেমেন্ট ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় নিমিষেই স্থানান্তর করা যাচ্ছে অর্থ। জনপ্রিয়তা পেয়েছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসও (এমএফএস) নগদ অর্থের লেনদেন কমাতে পেমেন্ট ব্যবস্থা সহজ আধুনিক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও কমছে না নগদ অর্থের লেনদেন। বরং প্রতি বছরই দেশে নগদ অর্থের লেনদেন বাড়ছে।

কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দিনে ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ জমা বা উত্তোলন হলে তার জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) রিপোর্ট করতে হয়। ধরনের লেনদেনকে ক্যাশ ট্রানজেকশনস বা নগদ লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করে থাকে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন হয়েছিল লাখ ৬৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ ১৪ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।  সে হিসেবে তিন বছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন বেড়েছে ২০৯ শতাংশেরও বেশি।

ক্রমবর্ধমান নগদ অর্থের লেনদেনের ঘটনায় নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বিএফআইইউ। মূলত উপার্জিত অর্থের উৎস গন্তব্য গোপন রাখতে মানুষ নগদ লেনদেনের আশ্রয় নিচ্ছে বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বিএফআইইউর ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় দেশের ব্যাংক খাত অনেক বেশি ডিজিটালাইজড। সরকারের পক্ষ থেকেও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এবং অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার পরও প্রতি বছরই নগদ লেনদেন বেড়েই চলছে।

পেমেন্ট ব্যবস্থাকে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আধুনিক করে সাজিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজের (বিএসিএইচ) দুটি উইংবাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেম (বিএসিপিএস) এবং বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্কের (বিইএফটিএন) সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইস বাংলাদেশ (এনপিএসবি), রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টসহ (আরটিজিএস) -পেমেন্ট গেটওয়ের বিভিন্ন পেমেন্ট ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। গ্রাহকরা চাইলে সহজেই এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে যেকোনো অংকের অর্থ স্থানান্তর করতে পারছেন। এর পরও নগদ অর্থের লেনদেন বাড়াকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নগদ যে লেনদেন হচ্ছে, তার বড় অংশই ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ। সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশ নগদ লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কারণে চেষ্টা করেও নগদ লেনদেন কমানো যাচ্ছে না।

বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বণিক বার্তাকে বলেন, নগদ লেনদেনের লাগাম টানতে বিশ্বের অনেক দেশেই এর সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও নগদ লেনদেনের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া দরকার। একটি নির্দিষ্ট অংকের চেয়ে বেশি অর্থ চেকের মাধ্যমে লেনদেনের বাধ্যবাধকতা আরোপ হলে সরকারও উপকৃত হবে। নগদ লেনদেন কমানো সম্ভব হলে সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স আয় বাড়বে। তাছাড়া চেকসহ ডিজিটাল প্রতিটি মাধ্যমে লেনদেন করা অনেক বেশি সহজ নিরাপদ।

বিএফআইইউর তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোয় নগদ লেনদেন হয়েছিল কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ৭২১টি। টাকার অংকে লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৭১ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোয় নগদ লেনদেনের সংখ্যা  অর্থের পরিমাণ দুটিই বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোয় ১০ লাখ টাকার বেশি এমন অর্থের নগদ লেনদেন হয়েছে কোটি লাখ ৬৯ হাজার ৩৬৫টি। এর মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। নগদ লেনদেনের মাত্র ১৮ শতাংশ ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। বাকি ৮২ শতাংশ লেনদেনই ছিল প্রাতিষ্ঠানিক।

দেশের ব্যাংক খাতে মোট নগদ লেনদেনের ৫১ শতাংশই হচ্ছে ঢাকা বিভাগে। বিএফআইইউর তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকা বিভাগে নগদ লেনদেন হয়েছে লাখ ৩৬ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগে লাখ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয়েছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোয় নগদ লেনদেনের ১৪ শতাংশ। এর বাইরে খুলনা বরিশালে শতাংশ, রাজশাহীতে , রংপুরে , ময়মনসিংহে সিলেটে শতাংশ নগদ লেনদেন হয়েছে।

বিএফআইইউর পর্যালোচনা বলছে, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি। অবৈধ চোরাচালান, মাদক অস্ত্রের ব্যবসা এবং হুন্ডি তত্পরতার কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন বেশি হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি নগদ লেনদেন হয়েছে যশোরে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাটিতে গত অর্থবছরে নগদ লেনদেন হয়েছে ২৭ হাজার ৫৫১ কোটি টাকার।

যশোরের একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যশোরে ট্রেডিং ব্যবসা ঘিরে বিপুল পরিমাণে নগদ অর্থের লেনদেন হয়। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে নগদে লেনদেন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করেও তাদের দিয়ে চেক বা অন্য কোনো মাধ্যমে লেনদেন করানো সম্ভব হয় না। তবে বেনাপোল স্থলবন্দরসহ সীমান্তের অবৈধ চোরাচালানোর বড় রুট হওয়ার কারণে যশোরে নগদ অর্থের প্রবাহ বেশি। তাছাড়া দেশে হুন্ডি তত্পরতার একটি বড় হাব হয়ে উঠেছে যশোর।

সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নগদ লেনদেন হয় কুমিল্লায়। দেশের অন্যতম বৃহৎ জেলাটিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে নগদ লেনদেন হয়েছে ২৭ হাজার ১০ কোটি টাকা। এছাড়া নগদ লেনদেনের দিক থেকে দেশের শীর্ষ ১০টি জেলার মধ্যে ময়মনসিংহে ২২ হাজার ১৫৬ কোটি, দিনাজপুরে ২১ হাজার ২০৭, নওগাঁয় ১৮ হাজার ৮৩, সিলেটে ১৭ হাজার ১৫৩, জামালপুরে ১৬ হাজার ৮৯৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ হাজার ৯১৫, ফেনীতে ১২ হাজার ৩৩৪ নীলফামারীতে ১১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।

অর্থ পাচার প্রতিরোধ অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ করতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বলে জানান সংস্থাটির প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ১০ লাখ বা তার বেশি অর্থ ব্যাংকে নগদে জমা কিংবা উত্তোলন হলে বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে হয়। আগে ধরনের রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটি কিছুটা জটিল ছিল। সচেতনতার অভাব থাকায় অনেক ব্যাংকার যথাসময়ে রিপোর্ট করত না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকারদের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটিও সহজ করায় আগের চেয়ে বেশি অর্থ লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউতে আসছে। নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থ পাচার প্রতিরোধ অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ করতেও আমরা সচেষ্ট রয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন