বিদেশীদের বাড়ি কেনায় দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা

বিকল্পের খোঁজে কানাডায় অর্থ পাচারকারী বাংলাদেশীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অবৈধ অপ্রদর্শিত অর্থ পাচার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা কানাডায় বাড়ি কিনছেন। এতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ফুলেফেঁপে গত দুই বছরে কানাডায় বাড়ির দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। অবস্থায় দামের ঊর্ধ্বগতি থামাতে আগামী দুই বছর বিদেশীদের কাছে বাড়ি বিক্রি বন্ধে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে কানাডায় বাড়ির মূল্য কমে আসবে বলে প্রত্যাশা দেশটির সরকারের।

বাংলাদেশ থেকেও অর্থ সরিয়ে কানাডায় বাড়িসহ অন্যান্য সম্পদে বিনিয়োগ করেছেন অনেকেই। কানাডায় এরই মধ্যে স্থায়ী হওয়া বাংলাদেশীদের অভিযোগ, কানাডার হাউজিং খাতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে এক শ্রেণীর বাংলাদেশীও ভূমিকা রেখেছেন। উচ্চমূল্যে বিক্রি হওয়া এসব সম্পত্তির অনেকগুলোই কেনা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া দুর্নীতির অর্থ দিয়ে। কানাডা সরকারের নিষেধাজ্ঞার পর বিকল্প উপায়ের খোঁজ করছেন এসব বাংলাদেশী।

বাড়ি কেনার জন্য কানাডায় অর্থ স্থানান্তর করেছেন এমনই এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী জামসেদুল আলম (প্রকৃত নাম নয়) বছর তিনেক আগে পড়ালেখার জন্য ছেলেকে কানাডায় পাঠিয়েছিলেন জামসেদুল আলম। আগে থেকেই কানাডার টরন্টো শহরে একটি ফ্ল্যাট আছে ব্যবসায়ীর। তবে এবার একটি বিলাসবহুল বাড়ি কেনার চেষ্টায় ছিলেন তিনি। এজন্য প্রায় ৩০ লাখ ডলারের সংস্থানও করে রেখেছিলেন। বাড়ি কেনার জন্য একটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে শুরু করেছিলেন দেনদরবারও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কানাডা সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত জামসেদুল আলমের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ব্যবসায়ী জামসেদুল আলম খোঁজ নিচ্ছেন, কানাডা সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত পাশ কাটিয়ে কীভাবে দেশটিতে বাড়ি কেনা যায়।

বিকল্পের খোঁজ নিতে শুরু করেছেন কানাডায় টাকা পাচার করা অন্য বাংলাদেশীরাও। কানাডা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আজকাল পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী রনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন মূলত দুর্নীতিবাজ ঋণখেলাপিরা। নগদ টাকায় মিলিয়ন ডলারের বাড়ি কিনে এখানে ব্যবসাও শুরু করেছেন তারা। তবে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তে অনেক বাংলাদেশী সাময়িক বিপাকে পড়েছেন। তারা অর্থ সরিয়ে নিয়ে এলেও বাড়ি কিনতে পারেননি। কেউ আত্মীয়ের নামে, আবার কেউ বেনামে বাড়ি কেনার কথা ভাবছেন। যেহেতু কারো কারো ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের, তাই তারা কোনোভাবেই হাল ছাড়তে চান না। এরই মধ্যে রিয়েল এস্টেট খাতের ব্রোকারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন তারা।

জানা গেছে, কানাডায় বাড়ির দাম বৃদ্ধি নিয়ে চাপে আছে দেশটির সরকার। গত বছর বাড়ির দাম প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া দেশটিতে বাড়ি ভাড়া বেড়েই চলেছে। অবস্থায় কানাডা সরকার এপ্রিল বাড়ি কেনায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়। এতে বিদেশীরা আগামী দুই বছর কানাডায় বাড়ি কিনতে পারবেন না। লাগামহীন বাড়ির দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে জাস্টিন ট্রুডো সরকারের নেয়া বেশকিছু পদক্ষেপের এটি একটি অংশ। এছাড়া দুই বছর কানাডায় বিদেশীদের বাড়ি কেনা নিষিদ্ধ করা ছাড়াও এক বছরের মধ্যে যারা বাড়ি বিক্রি করবেন, তাদের জন্য কর বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে কানাডা সরকার। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম থাকছে। কানাডায় অবস্থানরত বিদেশী শিক্ষার্থী দেশটির স্থায়ী বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।

বিদেশীদের বাড়ি কেনা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করার আগে বছরের ফেডারেল বাজেট ঘোষণার সময় আবাসন খাত নিয়ন্ত্রণে কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিনা ফ্রিল্যান্ডও বেশকিছু পদক্ষেপের ঘোষণা দেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে চলতি বছরের ফেডারেল বাজেটে নতুন করে আবাসনের জন্য কয়েকশ কোটি ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া কানাডার নাগরিকরা যাতে আবাসন খাতে আসতে পারেন, এজন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন একটি সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট প্রথমবার বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কর ছাড় রয়েছে।

তবে খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিষেধাজ্ঞার ফলে সম্পত্তি বা বাড়ির দামে খুব একটা হেরফের হবে না। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের যে তারতম্য আছে তাতে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করছেন দেশটির আবাসন খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা।

ব্লুমবার্গ বলছে, কানাডার হাউজিং ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা হয় ব্লাইন্ড বিডিংকেও। দেশটিতে একটি পদ্ধতি রয়েছে যাতে যে কেউ অর্থের পরিমাণ গোপন রেখে নিলামের মাধ্যমে বাড়ি কিনতে পারেন। কারণে যার কাছে অর্থ রয়েছে সে বাজারের দামের তুলনায় লাখ লাখ ডলার বেশি দিয়েও বাড়ি কিনছেন। তবে এবার পদ্ধতি বাতিল চায় কানাডিয়ান রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন।

কানাডা সরকারের তথ্য বলছে, কভিড মহামারী শুরুর আগে প্রতি বছর তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশী কানাডায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। ২০০৬ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পিআর পেয়েছেন ৪৪ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশী। মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার বা কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই বিনিয়োগ কোটায় কানাডায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পাওয়া যায়। উন্নত জীবনের প্রলোভন ভাগ্যান্বেষণে পাশ্চাত্যের দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রবণতা বাংলাদেশীদের জন্য মোটেও নতুন নয়।

যদিও অভিযোগ রয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব বাংলাদেশী বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় স্থায়ী বসবাসের (পিআর) সুযোগ পেয়েছেন তাদের একটা অংশ মূলত অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় বিনিয়োগ করেছেন। দেশ থেকে নেয়া দুর্নীতি লুটের টাকায় সেখানে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তারা। কানাডায় তাদের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা কিংবা আয়ের উৎস নেই। অথচ যাপন করছেন বিলাসবহুল জীবন। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার্পণ্য নেই তাদের। অবৈধ অর্থ পাচার করে যারা কানাডায় বাড়ি কিনে বিলাসবহুল বসবাসের সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে সেখানে বসবাসকারী অন্য বাংলাদেশীদের এক ধরনের দ্বন্দ্বও তৈরি হচ্ছে। কমিউনিটিতে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে।

কানাডায় প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশী আছেন। যাদের বেশির ভাগ থাকেন টরন্টো বা তার আশপাশে। বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে কানাডায় অভিবাসন প্রথম শুরু হয় ২০০৭-০৮ সালে। যখন বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এছাড়া গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বহু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী কানাডায় গেছেন অভিবাসী হয়ে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সময়কালে বেশি গেছেন ব্যবসায়ীরা। তখন ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেয়া হতো, কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অংক বিনিয়োগ করে বা কানাডার সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে কানাডার সরকার এটি বন্ধ করে দেয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন