সাম্প্রতিক

অর্থনৈতিক নীতিতে ঘটে চলা নীরব বিপ্লব

রবার্ট স্কিডেলস্কি

সাম্প্রতিক অতীতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু অনন্যসাধারণ বিষয় ঘটেছে। অংশত কভিড-১৯-এর প্রভাবের কারণে পুরনো মতবাদ-গোঁড়ামি একটি নতুন বিষয়ে রূপ নিয়েছে। কিন্তু এটি হয়েছে এর বাস্তব প্রায়োগিকতা আদৌ আছে কিনা কিংবা আগের রীতিনীতিতে কোনো সমস্যা ছিল কিনা, তা স্বীকার না করা ছাড়াই।

উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাবেক ডেপুটি গভর্নর পল টাকার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, আর্থিক রাজস্ব নীতিতে মুদ্রানীতির এখন ব্যাক শিট গ্রহণ করা উচিত। অন্য কেন্দ্রীয় ব্যংকাররা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, ওইসিডি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কর্মকর্তারাও অনেকটা একই সুরে কথা বলছেন।

আমাদের আর্থিক ব্যবস্থার হর্তাকর্তারা খুব কমই স্বীকার করেন যে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অতীতে তারা কতটা ভুল করেছিলেন। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস সম্প্রতি স্বীকার করেছে, ২০১০ সালে তারা ব্যয়সংকোচনের পক্ষে যে সাফাই গেয়েছিল, তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এটি নিজের ভুল স্বীকারের (মায়া কুলপা) কাছাকাছি সম্পর্কিত একটি ব্যাপার, বিদ্যমান আর্থিক ব্যবস্থার এই দুর্গ থেকে আমরা যেমনটা আশা করতে পারি। এটি কয়েক বছর আগে বিরাজ করা সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির তত্ত্বের ফলে সৃষ্ট ভাঙনের বিপুলতা ধরতে অসামর্থ্যের ইঙ্গিতই প্রদান করে বৈকি।

২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের আগে অনেকেই বিশ্বাস করেছিল যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল পুরোপুরিভাবে আর্থিক নীতিনির্ধারকদের ব্যাপার। একই সঙ্গে তারা এও মনে করত যে মূল্যস্ফীতি টার্গেট করে সুদহার নীতির মাধ্যমে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা এটি (পড়ুন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা) পরিচালিত হওয়া উচিত। এটি এই গতানুগতিক বিশ্বাস থেকে এসেছিল যে অর্থনীতিগুলো আবর্তনিকভাবে স্থিতিশীল এবং এর ফলে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রিত। আর্থিক-রাজস্ব নীতি অনেকটা শিথিল বা সংকোচনমূলক হতে হবে, যেন ব্যয়সংকোচন বাজারে আস্থা চাঙ্গা করতে পারে।

মুদ্রানীতির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস ২০০৮-০৯ সালের উত্তাল অধোগতির সময়েও বজায় ছিল। যেমনটা বলা হয়েছিল যে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং বা অগতানুগতিক মুদ্রানীতি পুরনো সুদহার নীতি প্রতিস্থাপন করবে, যখন নামিক সর্বনিম্ন হার এর জিরো বাউন্ডে পৌঁছেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সব ধরনের কাল্পনিক ট্রান্সমিশন ম্যাকানিজম নিয়ে সর্বাত্মকভাবে কাজ করেছিল, যার মাধ্যমে তারা বন্ড বিক্রেতার হাতে যে বাড়তি নগদ অর্থ জোগান দিয়েছিল, তা প্রকৃত অর্থনীতিতে প্রবাহিত হবে। এক্ষেত্রে সম্ভাবনা উপেক্ষা করা হয়েছিল যে এর বেশির ভাগই হ্রাস পাওয়া ব্যাংক সঞ্চিতি বা আর্থিক সম্পদ পুনর্ভরণে যোগ হবে। আর এরই মধ্যে নিজস্ব ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে সরকারগুলোও তাদের ভূমিকা পালন করবে।

আর্থিক সম্প্রসারণ ব্যয়সংকোচনের সম্মিলিত ফলে প্রত্যাশিত পুনরুদ্ধার নিশ্চিতে ব্যর্থ হলেও তখনো মুদ্রানীতির থেরাপিতে বিশ্বাস শক্তিশালী ছিল, এমনকি ২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারী আঘাত হানার পরও। এটি ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত থাকা প্রকৃত অর্থনীতির অংশে শত শত বিলিয়ন নতুন কিউই মানি প্রবাহিত করার চিন্তা থেকে সরকারগুলোকে প্রতিহত করেছে। বরং তার চেয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন লোককে মজুরিসহ ছুটি দেয়ার নীতি গ্রহণের দিকে তাদের চালিত করেছে।

প্রকৃতপক্ষে মহামারী মোকাবেলায় পশ্চিমা দেশগুলোর গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল অগোছালো প্রকৃতির। নীতিনির্ধারকরা কারিগরিভাবে টেকসই গণপরীক্ষা, ট্র্যাকিং ট্রেসিং ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষকে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় গণ-লকডাউন লম্বা ছুটি গ্রহণের পথ বেছে নিয়েছিলেন, পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ যেমনটা করেছিল।

এখন রাষ্ট্রীয় তরফে অর্থপ্রবাহ জোগান কমে এসেছে। প্রণোদনার অনুপস্থিতিতে ঊর্ধ্বমুখী বেকারত্বের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ২০২০ সালে কভিড-পরবর্তী ইউরোপীয় অর্থনীতিগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সর্বোচ্চ মাত্রায় সংকুচিত হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। লম্বা ছুটির কর্মসূচিও প্রায় অবসানের দিকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বলছে যে তাদের নীতি হাতিয়ারও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এর অর্থ হলো, পুনঃপরিশোধ করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বন্ড হোল্ডারের আস্থা ধরে রাখতে তাদের সক্ষমতায় চিড় ধরেছে।

অবস্থায় আর্থিক রাজস্ব নীতিই একমাত্র সই। একটি কার্যকর রাজস্ব নীতি, প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয়ের লক্ষ্য পূরণের জন্য আমাদের জরুরি ভিত্তিতে একটি নতুন সামষ্টিক অর্থনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন।

বাস্তবতা হলো, আমরা চাহিদা সরবরাহ উভয় দিকেই অভিঘাতের মুখোমুখি। কাজেই পুনরুদ্ধার নীতিতে সরবরাহ দিকের বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে হবে। অন্য কথায়, সমস্যা উত্তরণে মানুষকে অর্থ দেয়ার চাহিদা দিকের প্রতিকার এবং পুনরায় তা পুনর্ভরণ বড়ই অপর্যাপ্ত। যদিও চাহিদা চাঙ্গা করার যেকোনো প্রত্যক্ষ উদ্যোগ জাতীয় আয় বাড়ানোর মাধ্যমে অপ্রত্যক্ষভাবেও সরবরাহ চাঙ্গা করবে, তবে সরবরাহ দিকের পদক্ষেপে ভয়াবহ ঘাটতি মূল্যস্ফীতি সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে। কারণে নতুন পর্যায়ে বিনিয়োগ যেকোনো আর্থিক প্রণোদনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত।

অন্যদিকে এই গুরুত্ব নীতিনির্ধারকদের প্রত্যক্ষ মনোযোগ সরবরাহের ওই ধরনের প্রকৃতির দিকে নিবদ্ধ করবে, যা ভবিষ্যৎ অর্থনীতিগুলোর জন্য প্রয়োজন হবে। স্বয়ংক্রিয়তা জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিতের জায়গা থেকে অতিমারী-পরবর্তী যেকোনো পুনরুদ্ধার নীতি কেবল আবর্তনিক স্থিতিশীলতা নয়, অর্থনৈতিক স্থায়িত্বশীলতা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যেও প্রণীত হওয়া উচিত।

রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি শুধু এই নয় যে মুদ্রানীতির চেয়ে এটি অধিক শক্তিশালী সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্ট্যাবিলাইজার (কারণ এটি অধিক লক্ষ্য স্থিরকৃত), বরং এও যে পুঁজি-মূলধন বণ্টনে সমর্থ আর্থিক ব্যবস্থা থেকে একমাত্র সরকারই বিচ্ছিন্ন সত্তা। নিছক আর্থিক যুক্তির ভিত্তিতে আমরা যদি প্রযুক্তি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করতে অনুমতি প্রদানে ইচ্ছুক না হই, তাহলে মারিয়ানা মাজুকাতো বর্ণিত মিশনমুখী সরকারি বিনিয়োগ কৌশলের প্রয়োজন হবে, যেখানে করায়ন নীতি অবিচ্ছেদ্য হিসেবে অঙ্গীভূত হবে।

দ্বিতীয় বড় আলোচনা আমাদের প্রয়োজন হবে রাজস্ব মুদ্রানীতির সম্পর্কবিষয়ক উদ্বেগগুলো নিয়ে। যুক্তরাজ্যে ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোয়েন্টিটেটিভ ইজিংয়ের সম্প্রসারণ যথাযথভাবে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধির দিকে গেছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের স্বাধীনতা এবং মূল্যস্ফীতি টার্গেটের বিশ্বাসযোগ্যতার ধারণা বজায় থাকতে পারবে কি, যখন গত বছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে আসছে?  

যদি সরকারকে সক্রিয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক হর্তকর্তা (খেলোয়াড়) হতে হয়, তাহলে আর্থিক প্লাবন নিয়ন্ত্রণে তার গতানুগতিক ভূমিকা পরিবর্তন কীভাবে করা হবে বা আদৌ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন। তবে সাম্প্রতিক অতীতের চেয়ে আরো সক্রিয় পাল্টামুখী নীতি এবং মূলধন বণ্টনে আরো বড় ভূমিকা যাতে রাখতে পারে, সেজন্য খোদ রাজস্ব নীতিগুলোও পুনর্লিখিত বা পুনর্বিবেচিত হওয়া উচিত।

এসব বিষয়ে মহামারী একটি উন্মুক্ত গণসংলাপের সুযোগ হাজির করেছে। আমরা আশা করি, বিতর্ক  বিরাজমান ব্যবস্থার ভেতরকার বোঝাপড়ার পদ্ধতি প্রতিস্থাপনে ভূমিকা রাখবে, যা বেশ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অর্থনৈতিক ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করে আসছে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

রবার্ট স্কিডেলস্কি: ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের রাজনৈতিক অর্থনীতির

ইমেরিটাস অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন