ব্যবসায়িক চাপের মুখে ইউনিক গ্রুপ

মেহেদী হাসান রাহাত

জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে মোহাম্মদ নূর আলীর হাত ধরে ইউনিক গ্রুপের উত্থান। এরপর একে একে আবাসন, হসপিটালিটি অ্যান্ড টুরিজম, সিরামিকস, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যাংক, জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্রোকারেজ হাউজ, ক্লিনিকসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে গ্রুপটি। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে খারাপ যাচ্ছে গ্রুপটির ব্যবসা। এছাড়া আইনি জটিলতায় আটকে গেছে সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনসহ দুটি প্রকল্প। সব মিলিয়ে ব্যবসায়িক চাপে রয়েছে ইউনিক গ্রুপ।

বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের আঘাতে বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশে হোটেল ব্যবসা কমতে থাকে। আর মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে ধস নামে খাতের ব্যবসায়, যা থেকে রক্ষা পায়নি ইউনিক গ্রুপও। দেশের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর মধ্যে বেশ জমজমাট ছিল ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের আওতাধীন দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা। মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় হোটেলটির ব্যবসা। একই অবস্থায় গ্রুপটির অন্য আরেক হোটেল হানসা রেসিডেন্সেরও। চলতি বছরের জুন থেকে সীমিত পরিসরে সবকিছু আবার চালু হলেও এখনো করোনা-পূর্ববর্তী পর্যায়ে যায়নি তা। বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ১৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যবসা করেছে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা হয়েছিল ১০২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা কমেছে ৮৬ শতাংশ। আর সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৯-২০ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ১৫৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে। যদিও ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ব্যবসা হয়েছিল ২১৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের ব্যবসা কমেছে ২৮ শতাংশ।

চালু হোটেলগুলোর পাশাপাশি গ্রুপটির ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক প্রকল্প বনানীর শেরাটন ঢাকা হোটেল নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এতে গ্রুপটির বর্তমান নগদ প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নগদ প্রবাহও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

রাজধানীর বনানীতে ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে শেরাটন ঢাকা হোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ইউনিক গ্রুপ। হোটেলটি নির্মাণে জমি নেয়া হয় সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে। ২০১৮ সালেই হোটেলটি চালুর কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে এখনো এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে ভবন নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। মূলত ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়ে সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বনানী মার্কেটে ৩০ তলা ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে ইউনিক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বোরাক কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে। নিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে দুই দফা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তলব করা হয়। ভবন নির্মাণ নিয়ে সিটি করপোরেশন দুদকের সঙ্গে ইউনিক গ্রুপের জটিলতা প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

কভিডের ধাক্কায় সামনের দুই-তিন বছর হোটেল ব্যবসায় মন্দা থাকবে। তাছাড়া কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদের অনেকেই বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমে মিটিংসহ যোগাযোগে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে হোটেল ব্যবসার সুদিন আবারো ফিরে আসবে কিনা সেটি মুহূর্তে বলা কঠিন। আর বাস্তবতায় ইউনিক গ্রুপ হোটেল ব্যবসা  সংকুচিত করার  উদ্যোগ নিয়েছে। রাজধানীর গুলশানে নির্মাণাধীন হায়াত সেন্ট্রিক অ্যান্ড হায়াত রেসিডেন্স হোটেলের কাঠামোগত নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেছে। ইন্টেরিয়রের কাজ চলছে। কিন্তু এটিকে হোটেলের পরিবর্তে পাঁচ তারকা মানের হাসপাতালে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউনিক গ্রুপ।

এদিকে আইনি জটিলতায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে ইউনিক গ্রুপের আরেক প্রকল্প সোনারগাঁও ইকোনমিক জোনও। বেসরকারি খাতের একাদশ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ২০১৬ সালের আগস্টে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) প্রাকযোগ্যতা সনদ পেয়েছিল ইউনিক গ্রুপের সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে তাদের শিল্প পরিকল্পনায় চীন, জাপান, ভারতসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা  বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন বলেও তখন গ্রুপটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মেঘনাঘাটে ৪৫০ একর জায়গার ওপর নির্মিতব্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে এলপিজি সিলিন্ডার, মোবাইল হ্যান্ডসেটপেট্রোকেমিক্যাল মোটর বাইক নির্মাণ কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। ইকোনমিক জোনে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার কৃষিজমি, নিম্নভূমি, জলাভূমি মেঘনা নদীর অংশের জমি ভরাটকে অবৈধ ঘোষণা করে গত ডিসেম্বর একটি রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ভরাট করা জমির মাটি অপসারণ করে ছয় মাসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে রায়ে। জনস্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিট মামলার ওই রায়ের ফলে আটকে গিয়েছে ইউনিক গ্রুপের বড় বিনিয়োগের এই অর্থনৈতিক অঞ্চল।

ইউনিক গ্রুপের সার্বিক ব্যবসায়িক অবস্থা সম্পর্কে জানতে কথা হয় গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর আলীর সঙ্গে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কভিডের কারণে হোটেল ব্যবসা কমে গেছে। বিদেশী নির্বাহীরা অনলাইনে কাজ সারছেন। বর্তমানে আমাদের যা ব্যবসা হচ্ছে সেটি মূলত দেশীয় গ্রাহকদের কাছ থেকে। ২৫ শতাংশ ব্যবসা আসছে বিদেশীদের কাছ থেকে।  মুহূর্তে ঢাকার অন্য যেকোনো হোটেলের চেয়ে আমাদের ব্যবসা বেশি। তবে কভিডের প্রভাব হোটেল ব্যবসায় সামনের দিনগুলোতেও থাকবে। তাছাড়া আমাদের হোটেলের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ তো আর দুবাই-সিঙ্গাপুর না। এখন একটি হোটেলের জায়গায় আমরা হাসপাতাল করার চেষ্টা করছি। এজন্য হায়াত সেন্ট্রিক অ্যান্ড হায়াত রেসিডেন্সকে কনভার্ট করে ফাইভ স্টার মানের হাসপাতাল করব। এ্যাপোলোর সঙ্গে বিষয়ে আমাদের এমওইউ হয়ে গেছে।

বনানীতে শেরাটন ঢাকা হোটেলের নির্মাণাধীন ভবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হোটেলটির নির্মাণাধীন ভবনের পাঁচ ভাগের চার ভাগের মালিকানার বিষয়টি আগেই সমাধান হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমরা ৩০ তলার অনুমোদনও নিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে কেউ কেউ ঈর্ষাবশত সমস্যা তৈরি করছে। প্রথম থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত মালিকানা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ভাগাভাগি হয়ে গেছে। আর বাকি অংশের  ভাগাভাগির জন্য চুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সোনারগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিষয়ে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ে কী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেটি সার্টিফায়েড কপি পেলে বোঝা যাবে। এর আগে মনগড়া কিছু বলা ঠিক নয়। তবে নদীর জায়গা দখলের তো প্রশ্নই আসে না। উল্টো নদীতে আমার ১৬০ বিঘা জায়গা ভেঙে গেছে। কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টিকেও তিনি অসত্য বলে উল্লেখ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন