আমদানি নথিতে অসত্য তথ্য নিশ্চিত হলেই দ্বিগুণ জরিমানা

রাশেদ এইচ চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরো

বহির্বিশ্ব থেকে পণ্য আমদানি প্রক্রিয়ায় নথিতে অসত্য তথ্য নিশ্চিত হলেই ফাঁকি দেয়া রাজস্বের কমপক্ষে দ্বিগুণ জরিমানা গুনতে হবে ব্যবসায়ীদের। অনিয়মের ব্যাপ্তি বিবেচনায় জরিমানা চার গুণও হতে পারে। সৎ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা অসৎ ব্যবসায়ীদের আইন পালনে বাধ্য করতেই মূলত পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন বিধান এরই মধ্যে বাস্তবায়নও শুরু করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

আমদানি হওয়া পণ্যের বিবরণ অনুযায়ী অসত্য তথ্য উদ্ঘাটন হলে এর আগে ফাঁকি দেয়া রাজস্বের সর্বোচ্চ তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানার সুযোগ ছিল। তবে সর্বনিম্ন জরিমানার পরিমাণ তাতে নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে আমদানিকারকের পক্ষ থেকে প্রভাব খাটিয়ে কিংবা সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে নামমাত্র জরিমানা দিয়ে পণ্য ছাড়িয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল। অনিয়মের ব্যাপ্তি বড় হলেও ছোট পরিসরে জরিমানা আরোপ করতে পারত কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। নতুন নিয়মে কমপক্ষে দ্বিগুণ জরিমানা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়ায় এখন সে সুযোগটি আর থাকছে না। কাস্টমস আইনের পেনাল্টি কলামে সেকশন ৩২-এর আওতায় অসত্য ঘোষণার জন্য জরিমানার নতুন বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, পণ্যের আমদানি নথিতে অসত্য তথ্য দেয়া হয়েছে এমন সন্দেহে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে মোট হাজার ৯৯৫টি চালান লক করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে হাজার ৪৪৮টি চালানেরই আমদানি নথিতে অসত্য তথ্য থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে কাস্টমসের এআইআর (অডিট, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ) শাখা। মাসভিত্তিক তথ্যে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৭২ শতাংশ অনিয়ম উদ্ঘাটন হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। মাসটিতে সন্দেহ কিংবা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে লক হওয়া ৩৩৭টি পণ্য চালানের মধ্যে ২২৫টিতেই সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে আমদানি নথিতে অসত্য তথ্য থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এআইআর শাখা।

এছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। বন্দরে পণ্যের চালান পৌঁছে গেলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের পক্ষ থেকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে কাস্টম হাউজে আগামপত্র (বিল অব এন্ট্রি) দাখিলের বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক -সংক্রান্ত শর্ত সীমাবদ্ধতা আরোপের পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধান সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন তৈরির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর তাই প্রজ্ঞাপন জারির পরই বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি সমীচীন বলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে এনবিআর।

কাস্টমস আইন অনুযায়ী আইজিএম দাখিলের পর অর্থাৎ বন্দরে পণ্য পৌঁছার ৩০ দিনের মধ্যে আগামপত্র দাখিল করে পণ্য খালাসের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সময়ের মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাস না করালে নিয়ম অনুযায়ী তা নিলামে তোলার কথা। কিন্তু আইজিএম দাখিলের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও পণ্য খালাসের পদক্ষেপ হিসেবে আগামপত্র দাখিল করা হচ্ছে না আমদানিকারকের পক্ষ থেকে। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ১০ হাজার কনটেইনার রয়েছে, যেগুলো বন্দরে পৌঁছেছে অথচ নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য খালাসে আগামপত্র দাখিল করা হয়নি। গত দুই বছরে এসব কনটেইনার বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। আইজিএমের বিপরীতে আসা যেসব কনটেইনার নির্দিষ্ট সময়ে বন্দর থেকে খালাস হয়নি, সেগুলোতে ঘোষণাবহির্ভূত আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য পাওয়ার নজির রয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমসবিষয়ক সম্পাদক ওবায়দুল হক আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জরিমানা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে আগামপত্র দাখিলের নির্দেশনা এনবিআরের পক্ষ থেকে যেভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, সেভাবেই প্রতিপালন হওয়া উচিত।

কাস্টমস আইনের নতুন বিধান সন্নিবেশের ফলে ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন দ্বিগুণ দণ্ড আরোপের বাধ্যবাধকতা এসে যায়, যা বাণিজ্য সহায়তার ক্ষেত্রে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করতে পারে বলে মত দিয়েছেন একাধিক কমিশনার। এরই পরিপ্র্রেক্ষিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে এনবিআরের পক্ষ থেকে দুটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদি কোনো অসত্য ঘোষণা অন্যায় লাভের বশবর্তী হয়ে অবৈধ অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত হয়, তবে ওই দণ্ডারোপের বাধ্যবাধকতা অবশ্যই পালনীয়। তবে অনিয়মের বিষয়টি অসাবধানতাবশত কোনো ঘোষণার কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করা গেলে ন্যায় নির্ণয়কারী বিচারিক প্রজ্ঞা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণই যুক্তিসংগত বলে এনবিআর মত দেয়। তবে এক্ষেত্রে নতুন সংযোজিত বিধানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, যারা আইনের যথাযথ পরিপালন করে দ্রুত পণ্য খালাস করে নিয়ে যাবে, তাদের সব ধরনের আইনি সহায়তা দেয়া হবে। তবে যারা আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে

সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। বন্দর থেকে পণ্য খালাস নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদির মধ্যে রয়েছেএলসি, প্রোফরমা ইনভয়েস, কমার্শিয়াল ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, মূল্য ঘোষণা ফরম, কান্ট্রি অব অরিজিন প্রভৃতি। বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি পণ্যের সিংহভাগেরই শুল্কায়ন হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নে সৎ ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে। আগে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে নথিতে অসত্য তথ্য ধরতে পারলে ফাঁকি দেয়া রাজস্বের সর্বোচ্চ তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানার বিধান ছিল। এতে ন্যূনতম কোনো সীমা না থাকায় তিন গুণের মধ্যে স্বাধীনভাবে জরিমানা আরোপ করা যেত। নতুন নিয়মে অনিয়মের ধরন বুঝে চার গুণ পর্যন্ত জরিমানার সুযোগ রাখা হয়েছে। আবার এতে সর্বনিম্ন লেয়ার দিয়ে দ্বিগুণ পর্যন্ত জরিমানার বিষয়টিও আইনি বাধ্যবাধকতা দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া আইজিএম দাখিলের পাঁচদিনের মধ্যে এখন থেকে ব্যবসায়ীদের আগামপত্র দাখিল করতে হবে। আইনি বাধ্যবাধকতায় আমরা এরই মধ্যে এর বাস্তবায়ন শুরু করেছি।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বল্প সময়ের মধ্যে আমদানি পণ্য খালাসের বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকাটা জরুরি। আমদানি নথিতে দেয়া কোনো তথ্য যদি না বুঝে কিংবা অসতর্কতার কারণে হয়ে থাকে, তবে সেটা বিবেচনায় নেয়া উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন