বন্যার বাস্তবতা: কতটা প্রাকৃতিক

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

দেশে এবছর  দফায় দফায় বন্যা। এখন পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। আক্রান্ত ২৫ জেলার লাখ লাখ মানুষ। দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা বন্যায় ভুগছে। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকান-বাজার, শিক্ষালয়, আশ্রয়কেন্দ্র, উপসনালয়,সড়ক-মহাসড়ক, ছোট বড় বাঁধ। মানুষের কৃষি-গবাদিপশু-হাঁস মুরগী-মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত । বন্যা কবলিত দেশের বিশাল এলাকার গ্রামীণ জনপদ- অর্থনীতি বিধ্বস্ত । খাবারের সন্ধানে, পানযোগ্য পানির জন্য, একটু আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ দিশাহীন। সর্বত্র নৈঃশব্দ হাহাকার।

বন্যার বিস্তৃতি, স্থায়ীত্ব আরো বাড়বে এমনটাই পূর্বাভাস। এখনই বৃহত্তর রংপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জামালপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ পুরো বন্যাকবলিত ও ঢাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুরও আক্রান্ত হচ্ছে। আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। 

লক্ষ্যণীয়, বন্যায় প্লাবিত অঞ্চল থেকে পানি সরে যেতে এখন সময় লাগে, ধীর গতিতে পানি যায় বঙ্গোপসাগরে। ফলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে, ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা হয় বেশি। মানুষের অভ্যস্ত জীবনে-কৃষি বা গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মে ফিরে যাওয়া বিলম্বিত হয়-অনিশ্চিত হয়। কৃষিজ উৎপাদন-অর্থনীতি  বাধাগ্রস্ত হলে সার্বিকভাবে দেশ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। সড়ক, সেতু, অন্যান্য অবকাঠামো পুনঃনির্মাণের বিশাল ব্যয়তো আছেই।

বন্যা অবশ্যই নতুন কিছু নয়। বৃষ্টি-অতিবৃষ্টি প্রাকৃতিক। পানি বাড়লে নদ-নদীতে পানি বাড়বে, কোথাও কোথাও লোকালয় প্লাবিত হবে, আবার পানি নেমে যাবে-এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বন্যার গতি-প্রকৃতি, স্থায়ীত্ব, ক্ষয়ক্ষতির বাস্তবতা এখন কি স্বাভাবিক? শুধু কি বৃষ্টিজনিত বানের পানির স্রোতে ভেসে যায় সব? 

চলমান-দৃশ্যমান বন্যা মূলত এক ধরনের ব্যাপক আকারের জলাবদ্ধতা; যা মানুষের সৃষ্টি। এ পরিস্থিতির উৎসের সন্ধান করলে দেখা যায়, উপনিবেশ আমল থেকে আজ অবধি সংশ্লিষ্ট সরকার ব্যবস্থাপনা কর্তৃক কথিত প্রয়োজনে অপরিণামদর্শী পরিকল্পনায় রেলসড়ক, সড়ক, বাঁধ, জলাধার, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়ে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছে-করছে। ফলে বন্যা ও নদ-নদীকেন্দ্রিক ক্ষয়ক্ষতি ক্রমান্বয়ে আজকের রূপ ধারণ করেছে। 

বাংলাদেশে বন্যার বর্তমান ধরন-কার্যকারণ নিয়ে গবেষণাপত্রের তথ্যে উঠে এসেছে- চীন, ভারত, নেপাল কর্তৃক গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ৫০০টি ব্যারেজ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। যেগুলোর জন্য পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে, ফলস্বরূপ উজানের ওইসব দেশে বন্যা ১০ দিন স্থায়ী হলে বাংলাদেশে হয় মাসাধিক কাল। 

ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় থেকে চীনের তিব্বত, ভারতের অরুনাচল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার, চীন তিব্বতের ব্রহ্মপুত্রে তার দেশের বৃহত্তম ‘জঙ্গমু’ বাঁধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জলাধার নির্মাণ করেছে। এছাড়াও চীন হুবেই প্রদেশে ইয়াংজি নদীতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ‘থ্রি জর্জেস’ হাইড্রো ইলেকট্রিক বাঁধ নির্মাণ করে বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করেছে। 

উজান দেশের ওইসব বাঁধ প্রকল্প এখনকার জলাবদ্ধতা রূপী বন্যার অন্যতম কারণ। যদিও চীনের ‘থ্রি জর্জেস’ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়া আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। 

এসব  প্রকল্পের কারণে চীন এখন বেশি বন্যাক্রান্ত। পূর্বাভাস, চীনে এবার ৪০ কোটি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

আর ভারতের মালদহ-মুর্শিদাবাদের গঙ্গায় বহুল আলোচিত ‘ফারাক্কা’ বাঁধ, উত্তরাখণ্ডের ভাগীরথী নদীর ‘তেহেরি’ বাঁধ, হিমাচল-পাঞ্জাবের ‘শতদ্রু’ বাঁধ- ওড়িশার ‘হীরাকুঁদ’ ও ‘ইন্দাবতী’ বাঁধ এখন বাংলাদেশ এমনকি ভারতের জন্যও সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

ভারতের আসাম, মেঘালয়, বিহারে এবছর যে অতিবৃষ্টি ও বন্যা দেখা দিয়েছে- এর জন্য ভারতকে হয়তো ফারাক্কার বাংলাদেশমুখী স্বপ্নদুয়ারগুলো খুলে দিতে হবে, যা বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ হয়ে দেখা দিবে।

 ভারতে এরই মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি নাজুক, শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে বন্যার কারণে, অবস্থার আরো অবনতির আশঙ্ক করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ ভারতেও যোগাযোগের উন্নতির নামে সমন্বয়হীন ভাবে রেলপথ, রাস্তা, সেতু তৈরি হওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বন্যা দেখা দিতো। সে সময়ে উল্লেখযোগ্য বন্যা ছিল ১৯৪৩ এর দামোদরের বন্যা। সে বন্যায় কলকাতা উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তখনও বাঁধ, রেলপথকে বন্যার জন্য দায়ী করা হতো। ওইসময় ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ লিখেছিল- ‘বন্যার জন্য দায়ী নদ নদী নয়, অতিবৃষ্টি নয়, দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ’।

এখনকার বাস্তবতা আরো আগ্রাসী। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নয়; উন্নয়নের ভ্রান্ত ধারণা, কর্মকৌশল, ব্যাপক শিল্পায়ন, বিস্তৃত নগরায়ন, বিদ্যুতের আকাশচুম্বী চাহিদার যোগান ইত্যাদি বহুমুখী কথিত প্রয়োজনে এ অঞ্চলে যত্রতত্র বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, জলাধার, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বহু প্রকল্প-স্থাপনা নির্মিত হয়েছে ও হচ্ছে। এরূপ উন্নয়ন চাহিদার ডামাডোলের প্রকল্পের কারণে দেশগুলো নিজেরাই এখন বন্যা-দুর্যোগে বিপদগ্রস্ত।

 এসবের প্রভাবে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থা বেশি শোচনীয়। বিগত ৪/৫ দশকে আত্রাই, পুনর্ভবাসহ দেশের অসংখ্য নদী ক্ষীণকায় বা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ নদনদী-জলাশয় প্রায় নিশ্চিহ্ন। শুধু কুড়িগ্রামেই ৫০ এর বেশি আর রংপুরে দেড় শতাধিক নদ-নদী উধাও! দুধকুমার ছাড়া ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার কোনো শাখা নদীর অস্তিত্বই নেই। গঙ্গাধর, গিরাই, হলহলিয়াসহ বহু শাখা নদীর নামই ভুলে গেছে মানুষ। 

অনেক শাখা নদী বাঁধ দিয়ে দীঘি বানিয়ে লিজ দেয়া হয়েছে। বহু জলাশয়-বিলগুলোর পানি আসা যাওয়ার পথ বন্ধ করে বাড়িঘর, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, নানারকম স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র ঘিরে বিশাল ত্রিমুখী বাঁধ এখন মানুষের গলার ফাঁস, এর পানি নিষ্কাশনের যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় অচল। কুড়িগ্রামের উলিপুর- চিলমারীর মানুষ এই বাঁধ ভাঙ্গার দাবি তুলছেন।

এগুলো কিছু খণ্ডচিত্র। নিশ্চিত করেই বলা যায়, সারাদেশের অবস্থা একইরকম। বাঁধ-সড়ক-স্থাপনার নির্বিচার প্রতিবন্ধকতায় নদ-নদী-বিল-জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, বৃষ্টির পানি-উজানের পানি ধারণক্ষমতা আর নেই। পানি ঢুকলে সহজে আর নামে না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। মানুষ তার সবকিছু নিয়ে প্রতিবছর বন্যা নামক জলাবদ্ধতায় ভাসছে-ডুবছে। 

প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের শতাব্দীকালব্যাপী চলমান যুদ্ধসম কার্যকলাপ এখন এসে  আত্মঘাতী হয়ে গেছে। মানুষের সৃষ্ট এরূপ বন্যা নামের ব্যাপক  জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ এখন আদৌ সম্ভব কি?


মোতাহার হোসেন চৌধুরী 

ইমেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন