নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব

বাগানেই নষ্ট হচ্ছে ফুল লোকসানের শঙ্কা ২৫০ কোটি

সুকান্ত হালদার

গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে জারবেরা ফুলের চাষ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুলাপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় দেশের সব হাটবাজার যান চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ফুল বিক্রি করতে পারেননি রবিউল। সময়ের মধ্যে এক লাখেরও বেশি ফুল বাগানেই পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১০ লাখ টাকার লোকসান হয়েছে তার।

শুধু রবিউলই নন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন সারা দেশে ফুল চাষ, বাজারজাত বিপণনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। হাটবাজার বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই লোকসান দিতে হচ্ছে তাদের। 

ফুলচাষীদের কেন্দ্রীয় প্লাটফর্ম বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় হাজার ৫০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার গড়ে উঠেছে। দেশের ছয় হাজার হেক্টর জমিতে এখন ফুল চাষ হচ্ছে। রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব ফুল বিক্রির জন্য দেশজুড়ে ২০ হাজারের বেশি ছোট-বড় ফুলের দোকান আছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই আছে সাড়ে ৪০০ পাইকারি ৩০০-এর মতো খুচরা ব্যবসায়ী। কিন্তু ফুল সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় গত ১০ দিনে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ফুল বাগানেই নষ্ট হয়ে গেছে। অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী এক মাসে ক্ষতির পরিমাণ ২৫০ কোটি পেরিয়ে যাবে।

ফুলচাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাটবাজার বন্ধ থাকায় বাগান থেকে ফুল তুলছেন না তারা। তাই বাগানেই মরে ঝরে যাচ্ছে সব ফুল। মরা ফুল স্তূপ করে রাখা হয়েছে বাগানের পাশে। চৈত্রের খরতাপে তা পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।

ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, বাজারে বিক্রি হওয়া মোট ফুলের ৩৫ শতাংশই গোলাপ। এছাড়া গ্লাডিওলাস ২৫, রজনীগন্ধা ২০, জারবেরা ১০ এবং গাঁদা অন্যান্য ফুল ১০ শতাংশ বিক্রি হয়। 

হর্টিকালচার সূত্র জানায়, প্রতি বছর দেশে ফুলের চাষ বাড়ছে। ২০১৬-১৭ সালে দেশে হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ সালে আরো এক হাজার হেক্টর বাড়ে। 

সাদুল্লাপুর গ্রামের ফুলচাষী মো. আলী জানান, গত ১৫ বছর ধরে ফুল চাষ ব্যবসা করছেন তিনি। গত কয়েক দশক ধরে তার পরিবারের সদস্যরা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে তার পাঁচটি ফুলের বাগান রয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তিনি কোনো ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। তার পাঁচটি বাগানে সার, কীটনাশক, আগাছা পরিষ্কার শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে দৈনিক খরচ পড়ে হাজার টাকার ওপরে। কিন্তু বর্তমানে তার আয় ঠেকেছে শূন্যের কোঠায়। আগে দৈনিক তিনি ৩০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করতেন। অবস্থায় খরচ দিয়ে বাগান টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, এক দশকের বেশি সময় ধরে ফুল চাষ ব্যবসা করছেন। তার বাগান দুটি। তিনিও একই পরিস্থিতির শিকার। অবস্থায় তিনিসহ অন্য ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করছেন। না হয় করোনার কারণে অনেক ফুলচাষীকে রাস্তায় নামতে হবে। 

এদিকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কাঁচা ফুলের বেশির ভাগই যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী আশপাশের এলাকার চাষীরা উৎপাদন করেন। এর বাইরে আরো ২৩টি জেলার চাষীরাও কম-বেশি ফুল উৎপাদন করছেন। সব জায়গায়ই একই অবস্থা। ফুল বিক্রি করতে না পারায় বাগানেই পচে ঝরে পড়ে যাচ্ছে ফুল।

গদখালীর পটুয়াপাড়ার ফুলচাষী মঞ্জুর আলম বলেন, পাঁচ বিঘা জমিতে জারবেরা চার বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছিলাম। কিন্তু গত ১৭ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফুল বিক্রি করতে পারিনি। আবার আসন্ন পহেলা বৈশাখেও একই অবস্থা হবে।

তিনি বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে সব অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফুল জেলার বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না চাহিদা না থাকায়। অবস্থায় গাছ বাঁচিয়ে রাখতে ফুল তুলতে হচ্ছেই। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় কাটা ফুলগুলো তারা গবাদি পশুকে দিয়ে খাওয়াচ্ছেন।

ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখের মতো বিশেষ দিবসে দেশে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। দিবসগুলোয় বাজারে ফুল ওঠানোর জন্য চাষীরা অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে তারা কয়েকটি বড় দিবসেও বাজারে ফুল তুলতে পারেননি। 

সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বণিক বার্তাকে বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের দেশের প্রতিটি সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ফুল উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। গত ১৫ মার্চ থেকে কোনো ফুলচাষী একটি ফুলও বিক্রি করতে পারেননি। আর ফুল সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশকিছু দিবস ছিল, সেগুলোও ধরতে পারিনি। সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছি আমরা। 

তিনি বলেন, সম্প্রতি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ফ্লাওয়ারস সোসাইটির পক্ষ থেকে কৃষিমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছি আমরা। সেখানে বেশকিছু দাবি তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, খাদ্য ঘাটতি পূরণ উল্লেখযোগ্য।

ব্যবসায়ী মনে করেন, সরকার যদি সংকটে দেশের ফুলচাষীদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া অচিরেই সম্ভব হবে। আর না হলে ঘোর বিপদ থেকে সহজেই মুক্তি মিলবে না তাদের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন