স্মরণ

নির্মোহ সুলতান

এস এম সুলতানের বাল্যবয়সের চরিত্র-গঠন সম্বন্ধে আহমদ ছফা লিখেছেন—

‘কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ যাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি। শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের বরে অভিশপ্তও।’

এস এম সুলতান, নড়াইলের চিত্রা নদীর পারের মাছিমদিয়া গ্রামে ১০ আগস্ট ১৯২৪-এ লাল মিয়া নামে জন্ম নেয়া প্রবাদপ্রতীম এই পুরুষ কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন আশ্চর্য যাদুকর। তার গোটা জীবন জুড়েই ছিল আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। আজন্ম নির্মোহ এই শিল্পী সেকারণেই শেষ বয়সে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়ে ঠেলে বেছে নিয়েছিলেন সংশ্রব-বিবর্জিত এক অন্য জীবন। ঠাঁই নিয়েছিলেন এক পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরে। সাপ-খোপেদের আখড়া ছিল সেখানটায়। তার বাড়িতে আরো ছিল হাঁস-মুরগি এবং ২২টি বেড়াল।

এস এম সুলতানের কুহেলিকাময় জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জীবনী এখন পর্যন্ত রচিত হয়নি। খণ্ড খণ্ডভাবে জানা যায়, শিল্পী এস এম সুলতানের জন্ম ১০ আগস্ট ১৯২৪ সালে নড়াইলের চিত্রা নদীর পারের মাছিমদিয়া গ্রামে। দারিদ্র-ক্লেশে কেটেছে এই মহান শিল্পীর শৈশব। মাত্র ৫ বছরের স্কুলজীবনে ইস্তফা দিয়ে রাজমিস্ত্রী বাবার সহকারি হিসেবে বাড়ির কারুকাজ দেখতে দেখতে তার মনে লালিত হয়েছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার অদম্য বাসনা। আঁকতে শিখেছিলেন নিজ চেষ্টায়ই।

ছবি আঁকা শেখার জন্য সুলতান কলকাতা যেতেও প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় পড়তে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার পরিবারের কখনোই ছিল না। অবশেষে ১৯৩৮ সালে নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলতান কলকাতা যান। কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তিপরীক্ষা দেন এবং তাতে প্রথম হন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার অভাবে তিনি কলেজে ভর্তি হতে পারছিলেন না। এ সময় তৎকালীন প্রখ্যাত শিল্পসমালোচক ও কলকাতা আর্ট কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, শিল্পাচার্য শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে সুলতান কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। সোহরাওয়ার্দী সুলতানকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। তার অসাধারণ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য সবসময় উন্মুক্ত ছিল। এরপর প্রায় তিন বছর ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাসায় থেকে সুলতান লেখাপড়া চালিয়ে যান।

কিন্তু মানুষ হয়ে বিহঙ্গের মতো মন যার, তাকে প্রতিষ্ঠান আর কতক্ষণই বা আটকে রাখতে পারে। আর্ট কলেজের শেষ বর্ষে থাকাকালীন একদিন সুলতান বেরিয়ে পড়েন ভারত ভ্রমণে।

যাযাবরের চেয়ে কিছু কম ছিল না সুলতানের জীবন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি বেড়িয়ে পড়েছিলেন উপমহাদেশের পথে পথে। শহর বন্দরে ঘুরে ঘুরে তিনি তখন ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি আঁকতেন। সেসব ছবি বিক্রি করেই চলত তার জীবন। এরপর তিনি কাশ্মীরে গিয়ে কিছুকাল থিতু হন, বসবাস করতে শুরু করেন সেখানকার এক আদিবাসী দলের সঙ্গে। সে সময় এঁকেছেন প্রকৃতির ছবি। সিমলায় কানাডার এক নারী মিসেস হাডসনের সহযোগিতায় ১৯৪৬ সালে তার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়। কিন্তু বিহঙ্গ-জীবন যার সে শেকড় ছড়াবে না বলেই আবারো সুলতান উড়াল দেন কাশ্মীর থেকে। রওনা হন পাকিস্তানের লাহোর অভিমুখে।

১৯৪৭ সালে লাহোরে তার ছবির একক প্রদর্শনী হয়। ১৯৪৮ সালে আবারো লাহোর থেকে চলে যান করাচিতে।সেখানেও তুমুল খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তানের সরকারি প্রতিনিধি হয়ে আন্তর্জাতিক শিল্পী সম্মেলনে যোগ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এক প্রদর্শনীতে পিকাসো, সালভাদর দালির মতো শিল্পীর সঙ্গে প্রদর্শিত হয় তাঁর ছবি। পরবর্তীতে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন ও পরে লন্ডনে তার ছবির একক প্রদর্শনী করেন। দেশ বিভাগের পর কিছু দিনের জন্য সুলতান দেশে ফিরলেও এর এক বছর পর ১৯৫১ সালে তিনি করাচি চলে যান। সেখানে এক ফার্সি স্কুলে দু'বছর শিক্ষকতা করেন।

এভাবে দেশে বিদেশে প্রায় ২০টি প্রদর্শনী শেষ করে ১৯৫৩ সালে তিনি নড়াইলে ফিরে আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন শিশুদের জন্য স্কুল- নন্দন কানন । শিশুদের জন্য কিছু করার আগ্রহ থেকে শেষবয়সে তিনি ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় যখন আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে সে সময় দলছুট হয়ে সবার অলক্ষ্যেই রয়ে যান সুলতান। নড়াইলের ওই জীর্ণ ভাঙা বাড়িতে বসে ছবি আঁকেন ক্যানভাস এবং রঙ দিয়ে। বিদেশী ক্যানভাস ব্যয়সাপেক্ষ বলে আঁকতেন পাটের চটে। চটকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য জেলেরা তাদের জালে যেমন করে গাবের নির্যাস ব্যবহার করে, তিনিও তাদের মতো করে পাটের চটে গাবের নির্যাস ব্যবহার করতেন।

সুলতানের জীবনে লেপ্টে ছিল গ্রামবাংলার মাটি। তার সকল প্রেরণার উৎস ছিল সহজ-সরল গ্রামীণ জীবন। তাই এত গভীরভাবে, নিবিড়ভাবে, সমগ্র জীবন দিয়ে বাংলার কৃষকদেরকে অনুভব করেছিলেন এই মহান শিল্পী।

এখনো শিল্প সমালোচকদের অন্তরালে রয়ে গেছে নির্মোহ শিল্পী এস এম সুলতানের অসংখ্য ছবি। হারিয়ে যাওয়া ছবির তত্ত্বতালাশ চলছে। যেসব ছবি আমরা এখনো দেখিনি সেগুলোর সন্ধান পাওয়া গেলে হয়তো আরেক সুলতানকে আমরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হব।

বরেণ্য এই চিত্রশিল্পীর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মৃত্যুদিবসে আজন্ম নির্মোহ শিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র: এস এম সুলতান : জীবন দর্শন ও শিল্প, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।

আরও