মোগল ও নবাবি আমলে ঢাকায় নির্মাণ হয়েছে প্রচুর কাটরা। কাটরা ফার্সি শব্দ। এর অর্থ অতিথিশালা বা মেহমানখানা। তবে উল্লেখযোগ্য কাটরা ছিল সদরঘাটের মায়া কাটরা, মৌলভীবাজারের মুকিম কাটরা, নাজিমউদ্দিন রোড এলাকার নবাব কাটরা এবং কারওয়ান বাজারের একটি কাটরা। ঢাকায় মোগল ও নবাবি আমলে নির্মিত প্রাসাদ ও কাটরাগুলোর মধ্যে বর্তমানে শুধু বড় কাটরা ও ছোট কাটরারই অস্তিত্ব রয়েছে, যা এখন প্রায় অস্তিত্ব সংকটে আছে বলা চলে।
বড় কাটরা ও ছোট কাটরা নিয়ে ঢাকায় দুটি স্থাপনা আছে। সুবেদার শাহ শুজার আমলে নির্মাণ হয়েছে বড় কাটরা ও সুবেদার শায়েস্তা খাঁর সময়ে নির্মাণ হয়েছে ছোট কাটরা। বড় কাটরা নিয়ে দুটি শিলালিপি পাওয়া গেছে, যেগুলো ফার্সি ভাষায় লিখিত। সেখানে উল্লেখ আছে, একটি ১০৫৩ হিজরিতে (১৬৪৩-৪৪খ্রিঃ) লিখিত এবং অন্যটি ১০৫৫ হিজরিতে (১৬৪৫-৪৬খ্রিঃ) লিখিত। এর মধ্য এশিয়ার ক্যারাভান সরাইয়ের ঐতিহ্য অনুসরণে নির্মিত বড় কাটরা দারুণভাবে সুরক্ষিত এবং মোগল রাজকীয় সব স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য এতে বিদ্যমান। মোগল রাজধানী ঢাকার চকবাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থিত এ কাটরা।
বড় কাটরার ভগ্নদশা। ছবি: মাসফিকুর সোহান
সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪-৪৬ সালের
মধ্যে বুড়িগঙ্গার নদীর তীরে ইমারতটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আবুল কাসেম, যিনি মীর ই ইমারত নামে
পরিচিত ছিলেন। প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাস করার কথা
থাকলেও পরে এটি মুসাফিরখানা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। বলা হয়, শাহ সুজা ঢাকায় নিজের জন্য
নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন একটি প্রাসাদ। প্রাসাদ গড়ার ভার দিয়েছিলেন প্রধান স্থপতি
আবুল কাশেমকে। প্রাসাদ নির্মাণ হওয়ার
পর দেখা যায় এটি নবাবের পছন্দসই হয়নি। তখন তিনি এটি দান করে দিয়েছিলেন স্থপতি আবুল
কাশেমকে। তবে ১৬৪৪ সালের একটি শিলালিপিতে পাওয়া লেখা থেকে জানা যায়, পথিকদের জন্যে
সরাইখানা হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন এ বিশাল অট্টালিকা। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য
নির্মাণ করেছিলেন আরো ২২টি দোকান। মোগল আমলে এটি নায়েবে
নাজিমদের বাসস্থান তথা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতো।
একসময় স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারণে
বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকের কেবলই কিছু অংশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
১৮৬১ সালে ডয়লি অঙ্কিত বড় কাটরার উত্তর দিকের ফটকটি দেখে মনে হবে তখনই এটি প্রায় ধ্বংসের পথে ছিল। একসময় বড় কাটরার তোরণে ফার্সি
ভাষায় শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজি লিখিত একটি পাথরের ফলক লাগানো
ছিল। যেখানে এ মুসাফিরখানার নির্মাতা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের
ব্যয় নির্বাহের উপায় সম্পর্কে জানা যায়। ফলকে লেখা ছিল—
‘সুলতান শাহ সুজা সব সময়
দান-খয়রাতে মশগুল থাকিতেন। তাই খোদার করুণালাভের আশায় আবুল কাসেম তুব্বা হোসায়নি সৌভাগ্যসূচক
এই দালানটি নির্মাণ করিলেন। ইহার সঙ্গে ২২টি দোকানঘর যুক্ত হইল, যাহাতে এইগুলির আয়ে ইহার মেরামতকার্য চলিতে পারে এবং ইহাতে
মুসাফিরদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা হইতে পারে। এই বিধি কখনো বাতিল করা যাইবে
না। বাতিল করিলে অপরাধী শেষ বিচারের দিন শাস্তি লাভ করিবে। শামসুদ্দিন
মুহাম্মদ সিরাজি কতৃর্ক এই ফলকটি লিখিত হইল।’
বড় কাটরায় আছে সুউচ্চ রাজকীয় প্রবেশদ্বার। তিন তলাবিশিষ্ট এ প্রবেশপথ মনোরম ও সুদৃঢ়। ভবনটিতে মোগল রাজকীয় স্থাপত্য রীতির সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে। বড় কাটরা নির্মাণের পর সুবাদার হয়ে ঢাকায় আসার পর শায়েস্তা খাঁ ছোট কাটরার নির্মাণকাজ শুরু করেন। ধারণা করা হয়, বড় কাটরা নির্মাণের প্রায় দেড় বছর পর ছোট কাটরার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে বেশ তর্ক আছে। দানির মতে, ১৬৬৩-৬৪, আওলাদ হোসেনের মতে ১৬৬৩ আবার যতীন্দ্রনাথ তায়েশের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, শায়েস্তা খাঁ ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন ১৬৬৪ সালের ডিসেম্বরে। এর কাজ শেষ হয়েছিল ১৬৭১ সালে। প্রায় আট বছর সময় লেগেছিল। বড় কাটরা ও ছোট কাটরার পরিকল্পায় তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে বড় কাটরার তুলনায় ছোট কাটরা অপেক্ষাকৃত ছোট। এছাড়া নকশা বড় কাটরার মতোই। বড় কাটরার ১৮০ মিটার পূর্ব দিকে চকবাজারের সোয়ারীঘাট এলাকায় সুবেদার শায়েস্তা খাঁ নির্মাণ করেছিলেন ছোট কাটরা।
ছোট কাটরার একটি অংশ। ছবি: মাসফিকুর সোহান
বড় কাটরার দক্ষিণ গেটটি
তিনতলা। আর ছোট কাটরার দক্ষিণ গেটটি দোতলা। দক্ষিণ দিকের মূল প্রবেশদ্বারটি কম উঁচু হওয়ার
কারণে হয়তো আকৃতিতে বড় হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে
নির্মাণকৃতটিকে ছোট কাটরা নামে অভিহিত করা হয়।
কাটরা দুটোর অবস্থাই বর্তমানে শোচনীয়। দুই পাশে এবং
আদি কাঠামোর ওপর নতুন ভবন নির্মাণ করে হেরিটেজ ভবন ঢেকে দেয়ার ক্ষেত্রে ছোট কাটরার
অবস্থা বড় কাটরার চেয়েও খারাপ। অবশ্য ইংরেজ আমলে ছোট কাটরায় বেশকিছু সংযোজন
করা হয়েছিল, যা প্রশাসনিক কাজের জন্যই করা হয়েছিল বলে ধারণা করা
হয়। বর্তমানে ছোট কাটরার দক্ষিণ গেট ও উত্তর গেট শুধু দৃশ্যমান। এছাড়া ছোট কাটরার
পাশে বিবি চম্পার স্মৃতিসৌধটিকে দোকানপাট এমনভাবে ঘিরে আছে হয়তো সামনে ভবনের অন্য কোনো অংশ আর দেখা যাবে না। ছোট কাটরার উত্তর বাহু, পূর্ব
বাহু ও দক্ষিণ বাহুর প্রায় সম্পূর্ণ অংশে দুই পাশে ও ওপরে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পাশ
থেকে বা ওপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই নতুন নির্মাণ করা
ভবনের নিচে রয়েছে ছোট কাটরার আদি কাঠামো। তার পরও ছোট কাটরার আদি কাঠামো দেখতে হলে
কয়েক স্তর ভবন পেরিয়ে যেতে হবে।
মালিকানা নিয়ে যত প্রশ্ন
বড়
কাটরা ও ছোট কাটরার মালিকানা নিয়ে অবস্থানরতদের মধ্যে রয়েছে পরস্পর মতবিরোধ। গবেষকদের
মতে, ভবন দুটি প্রতিষ্ঠার সময় ওয়াকফ করা হয়েছিল। অবস্থানরতরা এ জায়গা অবৈধভাবে দখল
করে আছে। স্থানীয় যারা বড় কাটরা ও ছোট কাটরায় অবস্থান করছেন
তারাই মালিকানা দাবি করছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘বড়
কাটরা ও ছোট কাটরার ব্যক্তিমালিকানার দাবি ভিত্তিহীন। বড় কাটরা ও ছোট কাটরা নির্মাণের
সময় ওয়াকফ করে দেয়া হয়েছিল। তাই আইন অনুযায়ী এ সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা কোনোভাবেই
কেউ দাবি করতে পারে না। বড় কাটরার উত্তর গেটের শিলালিপিতে বিষয়টির উল্লেখ আছে। বড়
কাটরা ও ছোট কাটরা সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ। এ সম্পত্তির মালিক সরকার। দীর্ঘদিন ধরে
দাবি করা সত্ত্বেও হয়তো স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে বড় কাটরা ও ছোট কাটরা থেকে অবৈধ
দখলদারদের উচ্ছেদকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।’
এছাড়া বড় কাটরার উত্তর গেটের শিলালিপিটিতে
ভবন ও ভবনসংলগ্ন ২২টি দোকান ওয়াকফ করার কথা উল্লেখ আছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী,
ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে
বড় কাটরার দখলকারীরা নিজেদের বড় কাটরার স্বত্বাধিকারী বলে দাবি করে আসছেন।
বড় কাটরা ও ছোট কাটরাকে সংরক্ষণ করলে পর্যটক আকর্ষণের
সঙ্গে সঙ্গে রক্ষা হতো ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস। লালবাগ দুর্গ
এর একটি উদাহরণ। বিষয়টিও গবেষক মুনতাসীর মানুম তার ঢাকা সমগ্র-৩ বইয়ে যুক্ত
করেছেন। এছাড়া দুটি কাটরা, লালবাগ দুর্গ, সাবেক কেন্দ্রীয়
কারাগার, আহসান মঞ্জিল ইত্যাদি স্থাপনাকে ঘিরে তৈরি হতে পারে
একটি হেরিটেজ বলয়।
গবেষকদের মতে, কাটরা দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ইতিহাসের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও গবেষক দীর্ঘদিন ধরে বড় কাটরা ও ছোট কাটরাকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
সূত্র: ঢাকা সমগ্র-৩: মুনতাসীর মামুন