আর্কটিক বৃত্তের গভীরে, বিশাল হিমবাহ ও মেরুর বরফের নিচে, সুইডিশ ফটোগ্রাফার ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সিসিলিয়া ব্লমডাল খুঁজে পেয়েছেন এক অবিশ্বাস্য উষ্ণতা _ নরওয়ের উত্তরের উপকূল ও উত্তর মেরুর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত নরওয়ের স্বালবার্ড দ্বীপপুঞ্জ। বিশ্বের সবচেয়ে উত্তরের স্থায়ী বসতির স্থান এটি।
স্বালবার্ডের বৃহত্তম শহর লংইয়ারবাইনে প্রায়ি আড়াই হাজার বাসিন্দার মধ্যে ব্লমডাল একজন। ২০১৫ সালে স্বালবার্ডে আসার পর থেকে তিনি তার অনন্য জীবনযাত্রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লক্ষাধিক অনুসারীর জন্য তুলে ধরছেন। সম্প্রতি, তিনি তার বাড়ির শান্তিময় পরিবেশকে বিভিন্ন আভায় “লাইফ অন স্বালবার্ড” নামক একটি ফটোবুকে ধারণ করেছেন যেখানে সাগর নীলের ঝলকানিতে ঝিকিমিকি করছে স্থানটি।
নৈসর্গিক জীবনের চ্যালেঞ্জ
তবে স্বালবার্ড শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়। সমৃদ্ধ সম্পদে পরিপূর্ণ স্বালবার্ড অতীতে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বর্তমানে এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র। আবার অনেকের জন্য এটি একটি স্বপ্নের পর্যটন গন্তব্য।
কিন্তু ব্লমডালের মতে, স্বালবার্ডে জীবন সহজ নয়। এখানে তাপমাত্রা কখনো কখনো মাইনাস ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। আর মেরু ভাল্লুক ও আর্কটিক শেয়ালেরা মাঝে মাঝে শহরের রাস্তায় চলে আসে।
ব্লমডাল স্বালবার্ডের জীবনযাপন নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এখানে প্রতিদিনের অনুভূতি একেবারে ভিন্ন। কফি পান করার সময় উত্তরীয় আলো দেখা, মধ্যরাতের সূর্যের আলো, বা হরিণের কাছাকাছি থাকার মত অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে এ অঞ্চল।
এ কারণেই স্বালবার্ডের অধিবাসীরা এই কঠিন পরিবেশে জীবনের রহস্যময়তায় মুগ্ধ। প্রায় ৫০টি দেশের মানুষ বিজ্ঞান গবেষণা ও মৌসুমী পর্যটনে এখানে নিয়োজিত থাকে।
কেন আসে মানুষ?
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করছে। আচরণবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা এমন চরম পরিবেশে থাকে তারা হয়তো শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা যাচাই করতে চায়, ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে দূরে থাকতে চায় বা স্রেফ রোমাঞ্চের জন্য আসে।
ব্লমডাল বলেন, স্বালবার্ডের অদ্বিতীয় দৃশ্যের এক ঝলকই তাকে ইংল্যান্ড ও সুইডেনে তার কর্পোরেট উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এখানে একটি ধীরগতির প্রকৃতিসংলগ্ন জীবন বেছে নিতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি বলেন, এখানে সবকিছু এতটা সুন্দর যে মনে হয় এটি কোনো রূপকথার অংশ।
বিশ্বের প্রান্তে জীবন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্লমডাল তার প্রতিদিনের জীবনের ওপর স্বালবার্ডের পরিবেশের প্রভাব তুলে ধরেন। যেমন, নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে বাইরে গেলে ভাল্লুক থেকে রক্ষার সরঞ্জাম বহন করা জরুরি, এমনকি এটি আইনের আওতায় বাধ্যতামূলক।
বছরে দুটি অদ্ভুত আলোকযুগে চিহ্নিত করা হয় স্বালবার্ডেকে। এর একটি পোলার নাইট এবং আরেকটি মিডনাইট সান। পোলার নাইট নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে, তখন সূর্য দিগন্তের ওপরে ওঠে না। মিডনাইট সান এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে, তখনসূর্য অস্ত যায় না। এই ধরনের অবস্থার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ব্লমডালের মতো অনেকেই ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি অনুভব করেন, যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও মস্তিষ্কের কার্যকলাপের জন্য প্রয়োজনীয়। তবুও ব্লমডাল মনে করেন পোলার নাইট হলো বছরের সেরা সময়, যখন তিনি অন্ধকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন। তিনি এই সময়ের প্রশান্তি উপভোগ করেন এবং ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেন।
তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব স্বালবার্ডের জন্য বিশেষ হুমকি তৈরি করছে। লংইয়ারবাইন বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ছয় গুণ বেশি দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে, এবং গলিত পারমাফ্রস্ট ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা স্থানীয় অর্থনীতি ও অবকাঠামোর জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।
স্বালবার্ডের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। লংইয়ারবাইন শহরে একটি বিমানবন্দর, হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে – যা বিশ্বের উত্তরের সবচেয়ে দূরের প্রতিষ্ঠান। তবে এখানে বেশিরভাগ মানুষ গড়ে সাত বছর বসবাস করেন।