বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বর্তমানে একে যানজটের শহর বললেই ভালো হয়। ভাঙা রাস্তা, বিভিন্ন ধরনের যানবাহন নিয়ে মানুষের শহর ঢাকা। তবে শহরটিকে একসময় বলা হতো তিলোত্তমা নগরী। এখনো বলা হয়। সেই সঙ্গে শহরটির আছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস। সাধারণভাবে বলা হয় ঢাকার বয়স ৪০০ বছর। তবে সম্প্রতি এক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উঠে এসেছে নতুন সম্ভাবনা।
ঢাকা নিয়ে সবচেয়ে পরিচিত ইতিহাসটি হলো ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সুবাদার ইসলাম খান নগরটির পত্তন করেন। কিন্তু এখানে একটা বিষয় ভুলে যাওয়া হতো। কলকাতা যেমন জোব চার্নক পত্তন করেন, ইসলাম খান সেভাবে করেননি। জোব চার্নক প্রায় পাণ্ডববর্জিত একটি জংলা অঞ্চলে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে নগর পত্তন করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম খান যখন বাংলার সুবাদার হিসেবে ঢাকায় আসেন সে সময় এখানে মানুষের বসতি ছিল। শহর বা নগর না হলেও জনপদ ছিল ঢাকা। সে হিসাবে ঢাকার লিখিত ইতিহাস ১৬০০ সাল থেকে হলেও এ অঞ্চলে নগর ছিল আরো আগে থেকেই। বুড়িগঙ্গা আর শীতলক্ষ্যা ছিল তার প্রাণ।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে এক খননকার্য থেকে পাওয়া গেছে নতুন সূত্র। সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে একটি প্রাসাদের প্রমাণ। ধারণা করা হচ্ছে এ প্রাসাদ বা দুর্গ ১৪৩০ সালের। এত বড় দুর্গ প্রমাণ করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে এ জায়গাই হয়তো কোনো জনপদের কেন্দ্র ছিল, যাকে চলতি কথায় রাজধানী বলা যেতে পারে।
এ খনন থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকরা ধারণা করছেন খ্রিস্টের জন্মের বহু আগে থেকেই ঢাকা অঞ্চলে জনবসতি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকে ঢাকা অঞ্চলে জনবসতি/জনপদ ছিল বলে তারা মনে করছেন। সে হিসাবে ঢাকার বয়স আড়াই হাজার বছরের বেশি।
মঙ্গলবার এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে এ নিয়ে একটি আয়োজন হয়। সেমিনারটির নাম ছিল ‘পুরাতন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন: ঢাকার গোড়াপত্তনের বিশ্লেষণ’। এ আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সূফী মোস্তাফিজুর রহমান বেশকিছু তথ্য উপস্থাপন করেন।
মূলত সূফী মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও শিক্ষার্থীদের একটি টিম ২০১৭-১৮ সালে পুরান ঢাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করেন। এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণায় সহযোগী ছিলেন মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, মো. মামুন দেওয়ান, মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন, মো. আওলাদ হোসেন ও চাঁদ সুলতানা।
তারা কারাগারের প্রধান ফটকের সামনের অংশ, রজনীগন্ধা ভবনের আঙিনা, কারা হাসপাতালের সামনের অংশ, দশ সেল ও যমুনা ভবনের পশ্চিম এলাকা এ পাঁচ স্থানে ১১টি খননকাজ করেন। এতে তারা একটি প্রাচীন দুর্গের দেয়াল, কক্ষ, নর্দমা, কূপের সন্ধান পান। এছাড়া এখানে কড়ি, মোগল আমলের ধাতব মুদ্রা, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ভাস্কর্যসহ অনেক রকম প্রত্ননিদর্শন পেয়েছেন।
ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের বিষয়টি এখন অবধি সবচেয়ে জনপ্রিয় ন্যারেটিভ ছিল। এর অন্যতম কারণ মোগল আমলের নথিপত্র। বিশেষত আকবরের শাসনামলে বাংলায় অভিযান করতে আসা মোগল দলের সঙ্গে থাকা মির্জা নাথানের বয়ান। তিনি ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ বইয়ে লিখেছিলেন বাংলা অভিযানের বর্ণনা। তবে সে অভিযানে গুরুত্ব পেয়েছিল রাজমহল। বাংলার উত্তর-পশ্চিম অংশ নিয়েই মূল আলাপ ছিল।
কিন্তু ইসলাম খানের আগেই যে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জনবসতি ছিল তা বারো ভূঁইয়ার ইতিহাসে স্পষ্ট। এ নিয়ে আহমদ হাসান দানী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, দূর্গচন্দ্র সান্যালের লেখায় প্রমাণ আছে। তাছাড়া স্বরূপচন্দ্র রায়ের ‘সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস’, কেদারনাথ মজুমদারের বইয়ে সামান্য সূত্র মেলে। তাদের লেখা থেকে স্পষ্ট হয় যে ইসলাম খানের অন্তত ১০০ বছর আগেও ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জনবসতি ছিল। কেবল চাষবাস নয়, তাদের ব্যবসাও ছিল, যার মাধ্যম ছিল নদী।
এতসব কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য, ঢাকা যে কেবল মোগল সুবাদার ইসলাম খানের হাতেই পত্তন করা না, তার আগেই এ অঞ্চলে জনবসতি ছিল সেদিকে আলোকপাত করা। এ কথা সত্যি যে জনবসতি আর শহর এক বিষয় না, কিন্তু ঢাকা সম্পর্কে যা তথ্য মেলে, তাতে বোঝা যায় এ অঞ্চলে জনবসতি, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত ধারণার আরো অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সে ধারণাকেই প্রমাণ করছে।
নাজিমুদ্দিন রোড বিশেষ হয়ে ওঠে, কেননা এতে একডালা বা এগারসিন্দুরে আমাদের যেতে হবে না। বর্তমান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পেলেন ‘গ্রেজড মৃৎপাত্র’ (সিরামিকের মতো চকচকে মাটির পাত্র), রোলেটেড (মসৃণ ও নকশাদার) মৃৎপাত্র ইত্যাদি। উয়ারী বটেশ্বরের পর এ খনন থেকে পাওয়া সামগ্রীগুলো ঢাকাকে নতুন করে পরিচয় করাচ্ছে আমাদের কাছে। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে শহরটির নতুন ইতিহাস।