মাত্র ১০৭৩ টাকায় বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেল যাত্রা

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যাওয়ার পথে যতটা পথজুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখা যায় আর কোনো ভ্রমণে এতটা নিসর্গের খোঁজ পাওয়া যায় কিনা জানা নেই। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকাতেই যেন আলো-ছায়ার খেলা কমে আসে। এক উষ্ণ, সোনালি আভা ঢেলে দিয়ে বিস্তীর্ণ দিগন্তের দিকে ক্রমশ তার মনোমুগ্ধকর অবতরণ শুরু করে সূর্য, দিগন্ত চুম্বন করে।

বাংলাদেশে রয়েছে দীর্ঘ রেল ভ্রমণের সুযোগ। ঢাকা থেকে পঞ্চগড় ভ্রমণের এই যাত্রাপথে হয়েছে সৌন্দর্য্যময় নানাবিধ অভিজ্ঞতা। এই ভ্রমণের সব অংশের ছবি তুলেছি। একটা ছবি হাজার কথা বললেও মনের কিছু কথা না বলাই রয়ে যেতে পারে। সেই অনুভুতি থেকেই শুরু করলাম লেখা। এবার বলা যাক আমার এই অসাধারণ দীর্ঘ রেলযাত্রার সেইসব কথা।

আপনি কখনো ভেবেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলপথ কোনটি? হ্যাঁ, আমি এখন যে ভ্রমণের বর্ণনা দেব সেটিই হচ্ছে বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলপথ। ঢাকা থেকে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় পর্যন্ত ৬৯৩ কিলোমিটারের এই রেলপথটিই বাংলাদেশের দীর্ঘতম।

কাকতালীয়ভাবে আমার এক লেখক বন্ধু মাহমুদুল ইসলামের মাথায়ও তখন ঘুরছে পঞ্চগড় ভ্রমণের পরিকল্পনা। ইন্টারেন্ট থেকে টিকিট কাটলাম, দাম পড়ল ১০৭৩ টাকা। শ্রেণী স্নিগ্ধা (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত)। গন্তব্য সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়।

দিনটি ছিল শনিবার। মার্চের সেই হালকা শীতের সকালে ট্রেন ছাড়ার প্রায় ১ ঘণ্টা আগেই আমরা পৌঁছালাম স্টেশনে। তেমন ভিড় ছিল না সেখানে।

পৌঁছানো মাত্রই মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। ১৯৬০ সালে নির্মিত কমলাপুর স্টেশনটি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। ১৫ মিনিট দেরি করে ১০টা ২৯ মিনিটে চলতে শুরু করল একতা এক্সপ্রেস।

ট্রেন পৌঁছাল যমুনা নদীর ওপর অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সেতুতে। যতবারই এই সেতু পার হই ততবারই যমুনার বিশালতা আমাকে মুগ্ধ করে। সেতুর উপরে ট্রেনটি উঠার ঠিক আগমুহূর্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১৫ মিনিট মতো থামল। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেনটি উঠতেই চোখ পড়ল নদীর বুকে, সেখানে কিছু নৌকা ও ট্রলার।

ট্রেনে কোনো ডাইনিং কার ছিল না। বদলে ছিল একটা খাবার কক্ষ বা স্ন্যাক্স কর্ণার। সেখান থেকে অর্ডার করলাম লাঞ্চবক্স। সেখানে ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের সেই পুরনো কাটলেট আর পুরনো প্রথায় বানানো ফ্রায়েড চিকেন। সঙ্গে দুটি পাউরুটি আর একটা সসের প্যাকেট। এই খাবারে খুশি হওয়া কঠিন। তবে চকলেটের ফেরিওয়ালা আমাকে নিরাশ করেনি।

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যাওয়ার পথে যতটা পথজুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখা যায় আর কোনো ভ্রমণে এতটা নিসর্গের খোঁজ পাওয়া যায় কিনা জানা নেই। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকাতেই যেন আলো-ছায়ার খেলা কমে আসে। এক উষ্ণ, সোনালি আভা ঢেলে দিয়ে বিস্তীর্ণ দিগন্তের দিকে ক্রমশ তার মনোমুগ্ধকর অবতরণ শুরু করে সূর্য, দিগন্ত চুম্বন করে।

অনেকগুলো ক্রসিংয়ে থামায় নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা ৫৭ মিনিট পর রাত ১০টা ৫৭ মিনিটে ট্রেন থামল। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশনটিই দেশের সর্ব উত্তরের রেল স্টেশন। অল্প কিছু যাত্রীই অবশিষ্ট ছিল। বাকিরা নেমে গেছে আগের ২২টি স্টেশনে। ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের রোমাঞ্চকর যাত্রাপথের আপাতত সমাপ্তি।

রেল ক্রসিংয়ে দেরি, মধ্যাহ্নভোজে অতৃপ্তির পরেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক নৈসর্গের মাঝে দীর্ঘতম ট্রেন যাত্রার এই অভিজ্ঞতাকে আমি অসাধারণ বলব। এই যাত্রা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার স্মৃতির পাতায়।

লেখক— মো. জহিরুল ইসলাম (গ্রাফিক ডিজাইনার ও ভ্রমণপিয়াসী)

আরও