শত শত
বছর ধরে পোশাকে চাকচিক্য, ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য বজায় রেখে আসছে জারদোজি। জারদোজি হলো সোনালি সুতায় তৈরি সূচিকর্ম, যার
উৎপত্তি পারস্যে এবং পরে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। ড. বন্দনা ভাণ্ডরি যিনি একজন ভারতীয় টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ। তার বিখ্যাত বই জুয়েল্ড টেক্সটাই: গোল্ড অ্যান্ড সিলভার এমব্লিসড ক্লথ অব ইন্ডিয়া। সেখানে তিনি লিখেছেন, ভারতের
জারদোজিচর্চা অন্যতম ঐতিহ্য, যা পৃথিবীজুড়ে নথিভুক্ত ও প্রশংসিত।
এ শিল্পকর্ম মখমল, মসলিম, সিল্ক, অর্গানজা ও শিফনজাতীয় ব্যয়বহুল কাপড়ে করা হয়। ইতিহাসে কুষাণদের সময় থেকে এ কাজ স্কার্ফ, শাল ও চামড়ায় তৈরি হতো। গুপ্তরা খিস্টীয় চর্তুথ ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে এ সূচিশিল্পকে এগিয়ে নিয়েছিল। কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের জীবনীকার বানভট্ট (৫৯০-৬৪৭) তার গ্রন্থে হর্ষচরিতামানস ও কাদম্বরীতে সোনা ও মূল্যবান পাথরে অলংকৃত বিভিন্ন পোশাক, মাদুর, পাদুকা, গায়ের চাদর তৈরির কথা জানা যায়। ভারতের সোনা ও রুপার বিশাল মূল্যবান পণ্যের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে বাণিজ্য কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বণিক মার্কো তামিল পাণ্ড্য রাজ্যের সম্পদের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ভারতে থেকে কুশন ও মাদুর নিয়ে গেছেন। যেগুলো ছিল সুনিপুণভাবে সোনা ও রুপার তার দিয়ে এমব্রয়ডারি কাজ করা। ১৫ শতকে ইউরোপীয়রা জারদোজির নান্দনিক কাজের দ্বারা বিস্মিত হয়েছিল এবং ব্রোকেড আমদানি করছিল। নকশা করে নিজস্ব কিছু তৈরি করতে চেয়েছিল।
ভারতীয় ডিজাইনার সব্যসাচী কাজে জারদোজির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ছবি: সব্যসাচীর ফেসবুক
১৮৬৮
সালে ভারতের ভোপালে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, জরি-জারদোজির জটিল শিল্পের সূচনা হয়েছিল।
হার হাইনেস নবাব শাহ জাহান বেগমের শাসনামলে উৎসাহিত করা হয়েছিল এটি। জারদোজির বেশির ভাগ কারিগর ভারতের কানপুর, লখনৌ, গুজরাট, বিহার ও পুরান দিল্লি থেকে আনা
হয়েছিল এবং কারুকৌশলও তাদেরই ছিল।
ভোপালের
বেগমরা গর্বিতভাবে স্বর্ণের সূচিকর্ম করা জরি-জারদোজির কাজ করা ঐতিহ্যপূর্ণ পোশাক পরতেন। তারা পোশাকের
পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার জন্য পার্স বা বটুয়া তৈরি করাতেন। ঐতিহ্যবাহী এ বটুয়াগুলো
এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে একসময়
‘ভোপালি বটুয়া’ নামে পরিচিতি পায়। সে সময় মেয়েদের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের অংশ
হিসেবেও যোগ করা হয়েছিল জারদোজি। মোগল আমলের জারদোজি কাজগুলো দরবারের চিত্রগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এখনো
আমরা অনেক মাদুর, শাড়ি কাপড়ে মোগল চিত্র দেখতে পাই।
ঐতিহ্যবাহী জরির কাজটি আসল সোনা দিয়ে প্রলেপিত ও রুপার তার ব্যবহার করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সাশ্রয়ী মূল্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এ কাজ। আগে জারদোজি কাজে সালমা, সিতারা ও মূল্যবান অনেক পাথর দিয়ে তৈরি হতো এক-একটি কাজ। আধুনিক ফ্যাশনের কারণে চাপা পড়েছিল বেশকিছু সময় এ শিল্প। তবে ফ্যাশন ডিজাইনার ও এমব্রয়ডাররা এটি ফিরিয়ে এনেছেন। বর্তমান ফ্যাশনের সঙ্গে বিভিন্ন ডিজাইনার এ শৈল্পিক ধারাকে বেশ নতুন রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাদের জারদোজি কাজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
ছবি: টাইমস অব ইন্ডিয়া
বর্তমান
ফ্যাশন সচেতন বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত জরি-জারদোজির ব্র্যান্ড সুরাট। আর আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ আলোচিত ডিজাইনার হলেন রিতু
কুমার। তার ব্র্যান্ড নাম নিজের নামেই—রিতু কুমার এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে তার প্রতিটি ডিজাইন। তিনি ভারতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন প্রতিটি
কাজের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে রিতু কুমার ব্র্যান্ডের সুনিপুণ কারুকার্যখচিত ও নজর কাড়া একটি
লেহেঙ্গা কিনতে গুনতে হতে পারে লক্ষাধিক টাকা।