অনর্থক চিবিয়ে যাওয়া চুইংগামেরও আছে বিস্তৃত ইতিহাস

জ-লাইন শার্প করার জন্যই হোক কিংবা নিতান্তই স্বাদের কারণে- বাবলগাম বেশ জনপ্রিয়। চুইংগাম থেকেই কালের পরিক্রমায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে বাবলগাম। তবে ইংরেজিতে চুইংগামের সঠিক উচ্চারণ কিন্তু চিউয়িংগাম। অর্থাৎ, চিবিয়ে খাওয়া যায় যে গাম তাই মূলত চিউয়িংগাম। আর যে চিউয়িংগামকে বুদবুদের মতো ফোলানো যায় মুখের ভেতর থেকে তাই বাবলগাম।

হাঁটতে হাঁটতে একটা চুইংগাম মুখে পুরে দেয়া, চুইংগাম দিয়ে বাবল ফোলানো অথবা অনর্থক চিবিয়ে যাওয়া দীর্ঘসময় – এসব আমরা কেন করি, তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা বা বিস্তারিত বর্ণনা নেই। তবে একটু নেড়েচেড়ে দেখলেই পাওয়া যায় চুইংগামের আদ্যোপান্ত।

আধুনিক সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় এই বস্তুর ইতিহাস কিন্তু আবার প্রাচীন গ্রিকদের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। জানা যায়, প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা মাস্টিক গাছের রেজিন চিবাতো। তবে ১৯২৮ সালে ওয়াল্টার ডাইমার এমন একটি সঠিক গাম রেসিপি তৈরি করেছিলেন, যা প্রথমবারের মতো তৈরি করেছিল বাবল গাম।

তবে ডাইমার বাবলগামের আবিষ্কারক হলেও তিনিই প্রথম ব্যক্তি নন যিনি বুদবুদ বা বাবল তৈরির জন্য গাম বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। ১৮০০ এবং ১৯০০ সালের শেষের দিকেও বাবলগাম তৈরির চেষ্টা হয়েছিল।কিন্তু বাবল তৈরি করার মতো সফল হননি কেউই।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রাচীন চৈনিক, এস্কিমো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জীবনেও ছিল চুইংগাম। তবে এর আধুনিকায়ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এসে। বার্চ বা মাস্টিক গাছের রস মূলত রেসিন বা রজন। আদিবাসী আমেরিকান-ইন্ডিয়ানরাও এই রজনের গাম চিবোতো। ইংল্যান্ড যখন যুক্তরাষ্টের এই অঞ্চলটা দখল করে নেয়, তখন তারাও এ অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে।

যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৪৮ সালে জন বি কার্টিস প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চুইংগাম তৈরি করেন। এর নাম ছিল 'দ্য স্টেট অব মেইন পিউর স্পুস গাম'। তত দিনে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়ে গেছে। শিল্প খাতে লেগেছে উন্নতির হাওয়া। কার্টিসের স্প্রুস গামের গায়েও সে হাওয়া লাগে। তবে এর স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র দুই বছর। ১৮৫০ সালে বাজারে আসে প্যারাফিন মোম থেকে বানানো নতুন ধরনের চুইংগাম। এই চুইংগামের জনপ্রিয়তার তোড়ে ভেসে যায় স্প্রুস গাম।

তবে অনেকে চেষ্টা করলেও ডাইমারই প্রথম সফল বাবলগাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব পান। তখন ২৩ বছর বয়সী ডাইমার ফ্লিয়ার চুইংগাম কোম্পানির একজন হিসাবরক্ষক ছিলেন এবং তিনি তার অবসর সময়ে নতুন নতুন গাম রেসিপি নিয়ে পরীক্ষা করতেন। যখন তিনি প্রথমবারের মতো এমন একটি ফর্মুলা তৈরি করেন যা অন্যান্য চুইংগামের তুলনায় কম আঠালো, বেশি নমনীয় এবং যা চিবানোর সময় বুদবুদ তৈরি করতে সহায়ক, তখন ডাইমার ভেবেছিলেন যে এটি একটি দুর্ঘটনা। এই আবিষ্কারে তার এক বছর সময় লেগেছিল।

তারপর আবার সত্যিই একটি দুর্ঘটনা ঘটে। আবিষ্কারের পরের দিনই ডাইমার তার রেসিপিটি হারিয়ে ফেলেন। হারিয়ে যাওয়া রেসিপি খুঁজে পেতে তার চার মাস লেগে যায়।

ডাইমার তার রেসিপিতে নতুন গামের জন্য গোলাপি রঙ ব্যবহার করেছিলেন। কারণ, ফ্লিয়ার চুইংগাম কোম্পানিতে তখন শুধু গোলাপি রঙই পাওয়া যেত। তবে যে কারণেই বাবল গামের জন্য ডাইমার গোলাপি রঙ ব্যবহার করে থাকুন না কেন, এই গোলাপি রঙই বাবল গামের আজীবন সঙ্গী হিসেবে রয়ে গেছে।

আবিষ্কারের পর নতুন রেসিপি পরীক্ষা করার জন্য ডাইমার ১০০টি গামের নমুনা নিকটবর্তী একটি দোকানে নিয়ে যান এবং প্রতিটি এক পয়সা করে বিক্রি করেন। একদিনেই সব বিক্রি হয়ে যায়। ডাইমার একটি জনপ্রিয় নতুন ধরনের গাম তৈরি করেছে বুঝতে পেরে ফ্লিয়ার কোম্পানির মালিকরা ডাইমারের নতুন গামকে ডাবল বাবল নামে বাজারজাত শুরু করেন।

নতুন বাবলগাম বিক্রির জন্য ডাইমার নিজেই বিক্রয়কর্মীদের বাবল ফোলানোর পদ্ধতি শেখান, যাতে তারা সম্ভাব্য ক্রেতাদেরও শেখাতে পারে। বাজারজাতকরণের প্রথম বছরেই ডাইমারের তৈরি ডাবল বাবলের বিক্রি ১৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

১৯৩০ সালে ডাবল বাবলের বিক্রি বাড়াতে প্রচারণার অংশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল ফ্লিয়ার ফানিজ নামক রঙিন কমিক,, যেখানে চরিত্র ছিল ডাব এবং বাব। ১৯৫০ সালে ডাব এবং বাবকে বাদ দিয়ে তাদের পরিবর্তে পুড এবং তার সাথীদের কমিকে যুক্ত করা হয়।

তবে ব্যবসায় লোকসানও হয় ডাবল বাবলের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ল্যাটেক্স এবং চিনির ঘাটতির কারণে ডাবল বাবলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান চুইংগাম ও বাবলগাম তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

একুশ শতক নাগাদ চুইংগাম ও বাবলগামের তুমুল জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়ে। এর মূল কারণ ছিল, মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। চুইংগামের মতো হালকা জিনিসগুলো মানুষ মূলত কেনে ‘ইমপালস বায়িং’ এর ধারণা থেকে। ইমপালস বাই বলতে মূলত বোঝায় ক্ষণিকের তাড়নায় কিছু কিনে ফেলাকে। একুশ শতক নাগাদ মানুষ বেশ হিসেবী হয়ে ওঠায় তাই ইমপালস বায়িংয়ের তাড়না থেকে কিছুটা বের হয়ে আসে। তবে একুশ শতকে এসে চুইংগামের জনপ্রিয়তা একটু কমে গেলেও শত বছর ধরে টিকে থাকা এর বর্তমান অস্তিত্বই জানান দেয়, এটি এখনো বেশ জনপ্রিয়।

আরও