হাল জামানার ধরন অনুসারে দ্রুতই বদলাচ্ছে
মানুষের রুচি। পুরোনো দিনের অনেক কিছুই হারাতে বসেছে আজ। খাবারের কথা বললে, ঐতিহ্যবাহী
বাকরখানি বোধহয় সামনের সারিতেই থাকবে। একসময়কার জনপ্রিয় খাবারটি এখন মূলত পুরান ঢাকা,
চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কলকাতার নির্দিষ্ট অলিগলিতেই টিকে আছে। ভারতের লখনৌ ও পাটনার
শহরে মিলে শুধু রমজান মাসে।
সকালের নাশতায় অনেকেই এখনো চায়ের সঙ্গে
বাকরখানির স্বাদ নেন। কেউ কেউ বিকালে অথবা অল্প খিদেয় পেট ভরাতে পাতে রাখেন।
ঢাকা-কলকাতা দুই বাংলার প্রধান দুই
শহরের ঐতিহ্য অনুসারে, বাকরখানির ঐতিহ্য কয়েক দশকের। যেমন; কলকাতার পুরোনো অংশে যারা
এখনো বাকরখানি বানাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম কে আলি বেকারি, আশি বছরের বেশি সময় ধরে
তারা বাকরখানি তৈরি করছেন। অন্যদিকে সকালের মিষ্টি দুধ চায়ের সঙ্গে নোনতা বাকরখানি
পুরান ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। নাজিমউদ্দিন রোডের কয়েকটি দোকান দশকের পর দশক
বাকরখানি তৈরিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
সাধারণ মানুষের খাবার নিয়ে তত তত্ত্ব-তালাশ না করলেও রসিকদের অনেকেই জানেন যে, ফাস্ট ফুডের দুনিয়ায় আগা বাকের খানের স্মৃতি নিয়ে টিকে আছে বাকরখানি। যা এক বিয়োগান্তক প্রেমের গল্পও ।
ছবি: মাসফিকুর সোহান
প্রচলিত ইতিহাস অনুসারে, জমিদার আগা
বাকের তথা আগা বাকের খাঁ ও তার প্রিয়তমা খনি বেগমের নামানুসারে বাকরখানির নামকরণ। নবাব
মুর্শিদ কুলি খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী এ তরুণ যুদ্ধবিদ্যাতেও
পারদর্শী ছিলেন। তিনিই কিনা প্রেমে পড়েন রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগমের।
কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিলেন পথের কাঁটা। খনি বেগমকে জয়নাল প্রেম
নিবেদন করলে তিনি প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করেন
জয়নাল। খবর পেয়ে বাকের দ্রুত ছোটেন ও তলোয়ারযুদ্ধে জয়নালকে পরাজিত করেন।
জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর
দেন। তারা বলেন, জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন বাকের। ছেলের হত্যার বিচার চান
উজির। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ পুত্রসম বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। এরই মধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে
যায়। তিনি জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে যান দক্ষিণবঙ্গে। প্রিয়তমাকে উদ্ধারে পথে নামেন
বাকের। আর পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। বাকেরকে জয়নাল খান হত্যার চেস্টা করলে উজির
নিজেই ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। মৃত্যুর আগে খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে
হত্যা করেন জয়নাল।
দক্ষিণবঙ্গেই সমাধিস্থ হন খনি বেগম।
আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে রয়ে যান প্রিয়তমার সমাধির কাছে; যা আজকের বরিশাল। ১৭৪২
সালে উমেদপুর ও সালিমাবাদের জমিদার হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন। তার নামানুসারেই এ এলাকা
বাকেরগঞ্জ হিসেবে পরিচিত হয়। যা বর্তমানে বরিশাল। তিনি এলাকাটিকে সমৃদ্ধ বন্দর ও বাণিজ্য
কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। আর্মেনীয় ও পারসিক বণিকরা এখানে ভিড় জমান। আগা বাকের রান্না
করতে ভালোবাসতেন। এ সময় তিনি বিশেষ এক রুটি তৈরি করেন যার নাম দেন প্রিয়তমা খনি বেগমের
স্মৃতিতে— বাকরখনি। যা থেকে বাকরখানি।
১৭৫৪ সালে আগা বাকের মারা যান। তার
গল্পও বেশির ভাগ মানুষ ভুলে গেছেন। কিন্তু প্রেমিকার স্মৃতিতে তার রেখে যাওয়া বাকরখানি
মানুষের খাদ্য তালিকায় টিকে আছে।
বাকেরগঞ্জ থেকে পুরো বাংলা এমনকি কাশ্মীরেও পৌঁছে যায় বাকরখানি। এ অঞ্চলে আসা কাশ্মীরী বণিকদের মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যদিও এ যাত্রাপথ নিয়ে মতভিন্নতা আছে। বিভিন্ন দিকে যাত্রা করে বাকরখানিতে যুক্ত হয়েছে নানা বৈচিত্র— কোথাও পনির দেয়া হয় আবার কোথাও শুকনো ফল। হায়দরাবাদ ও কাশ্মীরে বিয়ের অনুষ্ঠানে বাকরখানি পরিবেশনের রীতি প্রচলিত।
ছবি: মাসফিকুর সোহান
মূলত সাত ধরনের বাকরখানি হয়। মিষ্টি,
নোনতা, পনির, ঘি, খাস্তা, মিষ্টি ঘি ও ঝাল বাকরখানি। ঝাল বাকরখানিকে আবার ঝুড়া বা ঝুরা
বাকরখানিও বলা হয়। তবে পুরান ঢাকায় নোনতা বাকরখানি বেশি জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে বাকরখানি
কয়েক শতকেও আকার-আকৃতি একইরকম রেখেছে। আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাকরখানির প্রার্থক্য
রয়েছে। এখনো স্থানীয় খাদ্য সংস্ক্তিতে একটি জনপ্রিয় আইটেম হিসেবে বিবেচিত। উপমহাদেশে
বাকরখানি ও চায়ের কাপ এক বিশেষ বন্ধন তৈরি করেছে। বাকরখানি ভারতের পাটনায় হিন্দু ও
মুসলমানদের কাছাকাছি আসতে ভূমিকা রেখেছিল।
সময়ের পরিক্রমায় আগের জনপ্রিয়তা না
থাকলে বাংলাদেশে নানা উপলক্ষে বাকরখানির নাম সামনে আসে। তবে ফাস্টফুডের মতো যেখানে
সেখানে মিলবে না। কোথায় পাওয়া যাবে তা জানতে খোঁজ নিতে হবে। পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরতেই
মিলবে পুরনো কিছু দোকান। কাচের বাক্স ভর্তি করে রাখা বাকরখানি। অবশ্য হাল সংস্কৃতিতে
বেশ কিছু ইভেন্টে যুক্ত হয়েছে বাকরখানি। তেমনই একটি ‘ব্রেকফাস্ট উইথ বাকরখানি’।
আফগানিস্থানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলো
ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বাকরখানির চল রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া প্রেম প্রায়শই
কবিতা, গল্প বা উপ্যাসের মাধ্যমে ইতিহাসে উদযাপিত হয়েছে। তবে কোনো খাবারের মধ্যে হারানো
প্রেমের গল্প রয়েছে সম্ভবত শুধু বাকরখানিতেই।