শাড়ির ইতিহাস প্রাচীন ভারত থেকে শুরু করে আধুনিককালের ফ্যাশন ক্যাটওয়াক পর্যন্ত বিস্তৃত। অনাড়ম্বর ও বহুমুখী এ পোশাক যেন ব্যবহারকারী নারীর গল্পই তুলে ধরে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে নারীর অন্যতম পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে শাড়ি। ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েক কোটি নারীর আটপৌরে পোশাক এ শাড়ি। তবে একুশ শতকের নারীর ফ্যাশনের ক্ষেত্র হিসেবে শাড়ির গল্পটি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
উনিশ আশির দশকে ভারতীয় চিত্রকর রাজা রবি বর্মণের বিখ্যাত চিত্র ‘গ্যালাক্সি অফ মিউজিসিয়ান’
সমগ্র ভারতজুড়ে রয়েছে হাজার রকমের শাড়ি। তবে শাড়ির মতো পোশাকের প্রথম দিকের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতায়, যা উত্তর-পশ্চিম ভারতের ২৮০০-১৮০০ খ্রিস্টপূর্বার্ব্দে বিকাশ লাভ করেছিল। শাড়ি শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে বলেই মনে করা হয়, যার অর্থ টুকরো কাপড়। তবে ঠিক কোন সময় থেকে এ পাঁচ-নয় মিটার আয়তকার টুকরো কাপড়টি নারীরা ব্যবহার শুরু করেছিল, অনেকেরই তা অজানা।
টুকরো কাপড়ের বর্ণনা অনার্য সভ্যতায় বহু আগে থেকেই ‘শাঢী’ শব্দটির প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। তাই কেউ কেউ মনে করেন, শাড়ির মূল শব্দই শাঢী। এছাড়া মহাভারতে দ্রৌপদীর যে বস্ত্রহরণের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটিও শাড়িই ছিল বলে অনুমেয়। ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ বছর আগে আর্যরা শাড়ি পরার প্রচলন শুরু করে।
সিন্ধু ও মেহের গড়ের মতো অনার্য সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত চিত্রে নারীদের পরনে শাড়ির মতো কাপড়ের ব্যবহার দেখা যায়। ধারণা করা হয়, ভারতের অনার্যরা সেলাই জানত না বলেই নারী, পুরুষ সবাই অখণ্ড বস্ত্র হিসেবে শাড়ি পরিধান করত। এ প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এ অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরনে থাকলে হতো ধুতি এবং নারীর পরনে থাকলে শাড়ি। সে সময় উচ্চ বংশের নারীরাই কেবল শাড়ির সঙ্গে পালা-পার্বণে ওড়নাজাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিতেন।
রামচন্দ্র মজুমদারের কথায় এর সমর্থনও পাওয়া যায়। তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসবের সঙ্গে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত শাড়ি পরেছে। ওপরে জড়ানো থাকত আধনা বা আধখানা। এসব এলাকা হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, অন্ধ প্রদেশ, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাব।
এছাড়া ইতিহাসে নানা সময় বিভিন্নভাবে শাড়ির গল্প উঠে এসেছে। টুকরো কাপড় হিসেবে ব্যবহৃত এ শাড়ি আগে বুদ্ধর ভাস্কার্যগুলোয়ও দেখা গেছে। সে অর্থে, মহেঞ্জোদারোর একটি মূর্তির ক্ষেত্রেও শাড়ির ব্যবহার দেখা যায়।
জনপ্রিয় এ মূর্তিকে প্রিস্ট কিং বা পুরোহিত রাজা বলা হতো। তাই পোশাক হিসেবে শাড়ি প্রায় তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই পরিচিত। তবে শাড়ি শব্দটির আরেকটি সম্ভাব্য মূল ব্যুৎপত্তিগত পালি শব্দ হলো সাতিকা, যার অর্থ নারীদের পোশাক। প্রাচীন নানা তথ্য পোশাক হিসেবে শাড়ি নারী পুরুষ উভয়ের ছিল বলেই প্রমাণ করে।
তবে ভারতীয়দের শাড়ি পরনের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল গ্রিক ও পার্সিয়ানরা। যাদের ভারতে বেশকিছু অভিযানের মধ্য দিয়ে আগমন ঘটেছিল।
এছাড়া সম্ভবত বিভিন্ন গোত্রের নারীরা নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে শাড়ি পরার ধরনে পরিবর্তন এনেছে। এক টুকরো কাপড়ে শরীর ঢাকার বিষয়টিতে পরিবর্তন এসেছে উনিশ শতকের শেষ দিকে। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা থাকতে হবে। এমনকি গোড়ালি দেখানোটাও অসম্মানকর হিসেবে বিবেচিত হতো। এ সময় শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ ও পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এর আগে মোগলদের আবির্ভাব শাড়ির বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নতুন সূচিকর্ম শৈলী, অলঙ্করণ ও নকশা, তাঁতিদের নকশা ইত্যাদি সমৃদ্ধ করেছে সমগ্র ভারতবর্ষকে। ঔপনিবেশিক যুগে বাংলায় শাড়ি ছিল আধা স্বচ্ছ মসলিনসহ আরো অনেক ধরনের কাপড়, যা বাংলার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর সঙ্গে মানানসই ছিল। কারণ শাড়ির নিচে কোনো পোশাক ছাড়াই শরীরে আবৃত রাখা যেত।
শাড়ি পরা হতো কুচি ছাড়া অনেকটা আটপৌরভাবে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নারীরা শাল বা ওড়না ব্যবহার করত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে (১৭৫০-এর দশক) ভারতীয় পোশাক, বিশেষ করে শাড়ি পরিধানের পদ্ধতিতে বিশেষ পরিবর্তন আসে। আশির দশকে ভারতীয় চিত্রকর রাজা রবি বর্মণের বিখ্যাত ‘গ্যালাক্সি অব মিউজিশিয়ান’ চিত্রের মধ্য দিয়ে ভারতের নানা প্রদেশের নারীদের শাড়ি পরিহিত অবস্থায় বাদ্যযন্ত্র হাতে দেখা যায়। চিত্রের মধ্যমণি ছিল একজন মারাঠী নারী।
শাড়ির ইতিহাস, অনেকটা এর ভাঁজের মতোই, স্তর ও জটিলতায় পরিপূর্ণ। এভাবে হাজার বছর ধরে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে রয়েছে শাড়ির ইতিহাস। কখনো মহাকাব্য, কখনো রাজদরবার, কখনো পুঁথি গ্রন্থে মিলেছে শাড়ির কথন। তবে শাড়ি বহন করে এ মহাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে, যা সময়ের পরিক্রমায় ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।